কৃষ্টি ও সংস্কৃতি
লিখছেন অরবিন্দ রায়
১৩ জানুয়ারি ২০২১
আজকের বিষয় :
পৌষ সংক্রান্তি উৎসব
সংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি একটা ফসলী উৎসব, যা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় পালিত হয়। ভারতে এই উৎসব অবশ্য রাজ্য ভেদে নানা নাম পেয়েছে। বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত—এমন নানা নামে এই একই উৎসব পালন করা হয়। হয়। গুজরাত এবং রাজস্থানে মকর সংক্রান্তি উত্তরায়ন নামে পরিচিত। হরিয়ানা এবং পঞ্জাবে এটি পরিচিত মাঘি নামে এবং কেরালায় মকর সংক্রান্তি পরিচিত মকরাভিলাক্কু নামে। শবরীমালা পাহাড়ের মাথায় সূর্যের প্রথম আলো পড়লে তা প্রত্যক্ষ করতে হাজির হন বহু পূণ্যার্থী। নেপালে এটা পরিচিত মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি-মা-লাও, মায়ানমারে থিং-ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে পরিচিত।
দেশের বেশিরভাগ রাজ্যের মকর সংক্রান্তি কৃষি উত্সব হিসেবে পালন করা হয়। মকর সংক্রান্তি থেকেই যেহেতু সূর্যের উত্তরায়ন শুরু হয়, তাই এই দিনটি বসন্ত ঋতুকে স্বাগত জানানোর দিন হিসেবে পালন করা হয়। জড় বিজ্ঞান অনুযায়ী, সূর্যের গতি দুই প্রকার, উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণ। ২১ ডিসেম্বর সূর্য উত্তরায়ন থেকে দক্ষিণায়নে প্রবেশ করে। এ দিন রাত সবথেকে বড় হয় আর দিন সবথেকে ছোট হয়। এরপর থেকে দিন বড় আর রাত ছোট হতে শুরু করে। মাঘ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত ছয় মাস উত্তরায়ণ। আবার শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত ছয় মাস দক্ষিণায়ণ। পৌষ মাসের সংক্রান্তিকেই বলা হয় উত্তর সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। শাস্ত্র মতে উত্তরায়ণে মৃত্যু হলে মুক্তি প্রাপ্তি হয় এবং দক্ষিণায়ণে মৃত্যু হলে ঘটে পুনরাবৃত্তি অর্থাত্ তাঁকে আবার সংসারে ফিরে আসতে হয়। মকর সংক্রান্তি থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী ছয় মাস ধরে চলে সূর্যের উত্তরায়ন। তারপর শুরু হবে সূর্যের দক্ষিণায়ন। উত্তরায়নে উত্তর গোলার্ধের কাছাকাছি আসে সূর্য।
প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব চলে আসছে। তবে সুস্পষ্টভাবে কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। এই মহাতিথিতেই মহাভারতের পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। আবার অন্য মত অনুযায়ী, এই দিনই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। প্রচলিত লোককথা অনুসারে পুরাকালে সংক্রান্তি নামে এক দেবতা শংকরাসুর নামে এক রাক্ষকে বধ করেছিলেন। আবার অন্য মতে, সূর্য এ দিন নিজের ছেলে মকর রাশির অধিপতি শনির বাড়ি এক মাসের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন। তাই এই দিনটিকে বাবা-ছেলের সম্পর্কের একটি বিশেষ দিন হিসাবেও ধরা হয়।
পৌষ সংক্রান্তিতে গ্রহণ করা হয় দধি সংক্রান্তির ব্রত। এ দিন সেই ব্রতের সূচনা, প্রতি সংক্রান্তিতে তার আচরণ এবং পরের বছর এই দিনেই ব্রতের প্রতিষ্ঠা বা সমাপ্তি। এই দিন দধি দ্বারা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীকে স্নান করিয়ে দধি ও ভোজ্য ব্রাহ্মণকে দান করা হয়। শোনা হয় ব্রতকথা। ফল-সংক্রান্তি ব্রতের অঙ্গ হিসাবে এই সংক্রান্তিতে হরিতকী দান করলে হংসযুক্ত রথে আরোহণ করে বৈকুন্ঠে গমন করা যায় বলে হিন্দুদের বিশ্বাস।
পৌষ সংক্রান্তিকে 'তিল সংক্রান্তি'-ও বলে। এদিন তিল দিয়ে নাড়ু, মিষ্টি তৈরি করে পূজায় নিবেদিত হয়। লোকবিশ্বাস, এই দিন তিল না খেলে নাকি দিন বাড়ে না অর্থাত্ সূর্যের মকর যাত্রা সংঘটিত হয় না। এদিন থেকেই সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে উত্তর গোলার্ধে ঢলে পড়ে।আসলে মকরই হলো বাঙালির আদি উৎসব, এবং ধর্ম বিবর্জিত উৎসব। মকর উৎসব একেবারেই ধর্মীয় উৎসব নয়। এই উৎসব আসলে নতুন বছরের উৎসব। তখনও বৈশাখ থেকে নতুন বছরের হিসেব চালু করেন নি আকবর বাদশা। মাঘ থেকেই বছর শুরু হতো, পৌষ সংক্রান্তি ছিল বছরের শেষ দিন।
বাংলায় মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তিতে মূলত নতুন ফসল ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করে 'পৌষ পার্বণ' উৎসব পালিত হয়। এই দিনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগরদ্বীপে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পুণ্যস্নান ও বিরাট মেলা বসে। মকর সংক্রান্তির দিন সাধারণত সূর্যদেবের পুজো করা হয়। তাঁর আশীর্বাদে আমাদের সকল রোগ-ব্যাধি দূর হয় বলে ভক্তেরা বিশ্বাস করেন। তাই এই বিশেষ দিনটিতে সকলেই নিজের ঘরবাড়ি, বিশেষ করে রান্নাঘর ও রন্ধন দ্রব্যাদি পরিষ্কার করেন, যাতে সমস্ত রকম ‘অপরিশুদ্ধতা’ দূর হয়। আসলে নিজের ঘরবাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার করে সুস্থতা বজায় রাখার জন্যই নিয়মটি পালন করা হয় বলে মনে করা হয়।
মকর সংক্রান্তির আর একটি বিশেষ আকর্ষণ ঘুড়ি উৎসব। এই দিন প্রত্যেকটি বাড়ির ছাদে ছোট-বড়রা মিলে ঘুড়ি ওড়ান। বাংলার অনেক স্থানে একসময় কুমারী মেয়েরা এইদিন থেকে কনকনে ঠান্ডার ভোরে একমাস ব্যাপী মকরস্নান-ব্রত শুরু করত। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা, জড়তা-তামসিকতার রিপুগুলিকে জয় করার এ ছিল এক সংগ্রামী মনোবৃত্তি। ছড়া গেয়ে পাঁচ ডুব দেওয়ার নিয়ম ছিল, পৌষ সংক্রান্তি দিনে গ্রাম-বাংলার অনেক স্থানে উঠোনে মড়াই-এর পাশে 'উঠোন লক্ষ্মী'র পুজো হয়। তিনিই কোথাও 'পৌষলক্ষ্মী'। এদিন বাড়ির উঠোন গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে, শুচি-স্নিগ্ধ করে তোলা হয়।
পৌষের সংক্রান্তির কথা উঠলেই ভেসে উঠে পিঠে, পুলি, পায়েস দিয়ে রসনাতৃপ্তি এবং ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সংক্রান্তির স্নান শেষে ধানের থেতে খড়ের বুড়ি মা-র ঘরে আগুন দিয়ে গ্রাম জুড়ে আট থেকে আশির শরীর উষ্ণ করার ছবি। এখানেই শেষ নয়, সবুজ শ্যামল গাঁয়ের বাড়ির বিরাট উঠোনে জায়া, জননীরা নানা রঙের আলপনা এঁকে ধান, দূর্বায় পুজো সারেন। ঘরের আসনে তিল-কদমায় ঠাকুর সেবা-সহ আরও নানা আয়োজন হয়ে থাকে পৌষ সংক্রান্তিতে।
মকর সংক্রান্তিতে পূণ্য অর্জনের জন্য গঙ্গায় স্নান করার রীতি রয়েছে। শুধু গঙ্গা নয়, ভোরবেলা যে কোনও জলাশয়ে ডুব দিলেই এই পুণ্যলাভ সম্ভব। পরপর মেলা হয়ে যায় পৌষ-মাঘ মাসে। ফাল্গুনেও চলে। নদীর ধারের মকর মেলার আরেক বড় আকর্ষণ হলো টুসু ভাসান।
রূপ পাল্টে যাচ্ছে এই পৃথিবীর। সামাজিকতার যে বিষয়গুলো কোনও এক সময় পরিবার-পরিজনদের মধ্যে অনাবিল আনন্দের পরশ এনে দিত, সেই আনন্দঘন সময়ের ছবি ধীরে ধীরে কমে আসছে। সংক্রান্তির আগেই গ্রামে গ্রামে ঢেকিতে, গানের মধ্যে চাল গুঁড়ো করার ছবিও হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে নগরায়নের ঠেলায়। তবে, শাস্ত্রে কিংবা প্রাচীন মহাকাব্যে পৌষ সংক্রান্তির ব্যাখ্যা যাই থাকনা কেনও, বর্তমানে এই দিনটি এখন আম বাঙালির কাছে নিছক একটি উত্সব। পিঠে পুলি খাওয়ার উত্সব।