বহমান বর্তমান
লিখছেন অরবিন্দ রায়
০৭ জানুয়ারি ২০২১
আজকের বিষয় :
শৈত্যপ্রবাহের নেপথ্যে
এত তাড়াতাড়ি এমন ঠান্ডা ২০০৩ সালের পর এই প্রথম। গত ৫৮ বছরে এই প্রথম শীতলতম অক্টোবর প্রত্যক্ষ করেছে দিল্লি। জম্মু ও কাশ্মীরের শ্রীনগরে গত ২৭ অক্টোবর পারদ ছিল শূন্যের কাছে। এমনকি পুনে, নাসিকের মতো আপাতভাবে উষ্ণ শহরেও অক্টোবরে রাতের তাপমাত্রার পারদ ছিল স্বাভাবিকের থেকে বেশ নীচে।
এর নেপথ্যে আসলে ‘লা নিনা’, যার মানে ছোট্ট মেয়ে। আসলে তাপমাত্রা কমছে প্রশান্ত মহাসাগরের জলতলের। আর তাতেই এই কাণ্ড! মৌসম ভবনের ডিরেক্টর জেনারেল বলছেন, ‘লা নিনার প্রভাবে উত্তর ভারত জুড়ে ভালো ঠান্ডা পড়ে। বিভিন্ন গবেষণায় সেটাই উঠে এসেছে। পূর্ব ভারতের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তেমন খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ সেই ঘটনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবার মৌসম ভবন পূর্বাভাস দিয়েই দিল, লা নিনার প্রভাবের ফলে এবছর প্রচন্ড ঠান্ডা হতে পারে শীতকাল।
বুঝতে হলে লা নিনা কে চিনতে হবে। এটি আসলে একটি পরিস্থিতি। অস্ট্রেলীয় আবহাওয়া দপ্তরের মতে, ক্লাইমেট ড্রাইভার। সাধারণ নিয়মে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে বাতাস বয়ে যায়। এর গতি কখনও বেড়ে যায় আবার কখনও উল্টো দিকেও ঘুরে যায়। গোটাটাই নিয়ন্ত্রণ করে মহাসাগরের মধ্য ও পূর্বাংশের জলতলের তাপমাত্রা। এই তল্লাটের তাপমাত্রা যখন নির্দিষ্ট সীমার উপরে উঠে যায়, তখন তাকে ‘এল নিনো’ নামে ডাকেন বিজ্ঞানীরা। আর তাপমাত্রা যখন নির্দিষ্ট সীমার নীচে নেমে যায়, অর্থাৎ ঠান্ডা হয়ে যায় জল, তখন বলা হয় ‘লা নিনা’। দুটোই স্প্যানিশ শব্দ। নিনো বা নিনা স্প্যানিশ শব্দ। স্প্যানিশ ভাষায় নিনো শব্দের অর্থ ছেলে আর নিনা শব্দের অর্থ মেয়ে। এল নিনো শব্দের অর্থ ছোট ছেলে এবং লা নিনা অর্থ ছোট মেয়ে। সর্বপ্রথম ১৬০০ সালে পেরুর জেলেরা এর অস্তিত্ব খেয়াল করে। স্বাভাবিক অবস্থায় পেরু ও ইকুয়েডর উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শীতল স্রোত আসে এবং এর সঙ্গে প্রচুর প্লাংটন ও মাছ থাকে। ফলে জেলেরা বেশি মাছ শিকার করতে পারেন। কয়েক বছর পরপর হঠাৎ উষ্ণ স্রোতের আবির্ভাব ঘটে। এতে প্লাংটন থাকে না। ফলে মাছও পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় নাম এল-নিনো। স্রোতের কারণে মাছ শিকারে বিঘ্ন ঘটে, ঝড়ঝঞ্জা ও বাড়ে। ফলে ফসলের ক্ষতি হয়। এল-নিনোর প্রভাব স্তিমিত হয়ে এলে দেখা দেয় সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা। তখন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে অতিশীতল স্রোত আসতে থাকে। এ সময় মাছ বেশি পাওয়া গেলেও আবহাওয়ার ওপর দেখা দেয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বায়ু থাকে শুষ্ক। ফলে বৃষ্টি হয় না, দেখা দেয় খরা। এ অবস্থাকে জেলেরা নাম দিয়েছেন লা-নিনা।
যেহেতু প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ। সুতারাং এই মহাসাগরের পরিবর্তনে পুরো পৃথিবীরই পরিবর্তন ঘটে আর ভূপৃষ্ঠ হতে জলভাগে পরিবর্তনে জলবায়ুর পরিবর্তন বেশি হয়। ১৯৬৩ সাকে বিজ্ঞানী গিলবার্ট দেখান যে এল নিনো বা লা নিনার সাথে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও বায়ুচাপের মধ্যে সম্পর্ক আছে। প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তাপমাত্রা শীতল হওয়ার প্রক্রিয়াই লা নিনা। অতিশীতল জল সমুদ্রের উপরে বায়ুমণ্ডল প্রভাবিত করে, জলবায়ুতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটায়, কেন্দ্রীয় এবং সমুদ্রতীর প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার বৃহৎ পরিসরে শীতলকরণের নাম দেওয়া হয় লা নিননা।
রেকর্ড করা সবচেয়ে শক্তিশালী লা নিনা মধ্যে ছিল 1988-1989 সালে যখন মহাসাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে 7 ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নেমে আসে। শেষ লা নিনা পর্বটি 2016 সালের শেষের দিকে ঘটেছিল এবং 2011 সালের জানুয়ারিতে লা নিনা এর কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।
ভারতের জলবায়ুর প্রধান নিয়ন্ত্রক হল মৌসুমি বায়ু। ভারত থেকে বহুদূরে পেরু ও চিলির প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ব্যতিক্রমী উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোত রূপে যথাক্রমে এল লিনো ও লা লিনো মৌসুমি বায়ুকে প্রভাবিত করে। ছিয়াত্তরের মনন্তর বা তেতাল্লিশের মনন্তরের কারণ ও ছিল এল নিনো। ১৯৭০, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৬ বছরগুলো ছিল লা নিনার বছর।