নাটক
হ্যালো পৃথিবী
চিত্রভানু ভৌমিক
শিলচরের বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক চিত্রভানু ভৌমিকের নতুন অপরিবেশিত নাটক "হ্যালো পৃথিবী"...

চরিত্রাবলি :
প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয়
দৃশ্য
১ম : কে কে ওখানে?
২য় : [ঝোপের আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়!] আমি- আমি
১ম : বল— কি করছিলে ওখানে।
২য় : আমি লুকিয়েছিলাম।
১ম : কেন?
২য় : আমি ভয় পেয়েছিলাম— তোমাকে—
১ম : আমাকে— নিরস্ত্র আমি? বরং আমারই তোমাকে ভয় পাওয়া উচিত ছিল।
২য় : কি করে বুঝব তুমি নিরস্ত্র ?
১ম : অস্ত্র থাকলে সেটা নিশ্চয়ই দেখা যেত।
২য় : না। কোন কোন অস্ত্র আজকাল হাতের তালুতেও জায়গা হয়- এমন অস্ত্র যা দশটা মানুষকে অনায়াসে খুন করতে পারে।
১ম : দেখ [২য় ভাল করে দেখে আশ্বস্ত হয়ে] তাকাও ভাল করে।
২য় : না। মনে হয়ে তুমি অস্ত্ৰহীন—
১ম : কিন্তু তুমি— তোমার কাছে অস্ত্র নেই তার প্রমাণ কিন্তু এখনও পাইনি।
২য় : অস্ত্র নেই— এইদেখ গাছের ডালটাকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করছি— শত্রু আক্রমন থেকে বাঁচতে৷
১ম : কে তুমি?
২য় : সে প্রশ্নতো আমারও—
১ম : আমি— মানুষ—
২য় : সেতো তোমার চেহারাতেই বোঝা যায়— কিন্তু তোমার পরিচয়?
১ম : মনে করতে পারছি না।
২য় : আমারই মত— জান আমিও মনে করতে পারছি না আমি কে— শুধু মনে আছে— একটা ভয়ঙ্কর শব্দ— মনে হচ্ছিল পৃথিবী গুড়িয়ে যাচ্ছে— তারপর হঠাৎ যখন জ্ঞান ফিরল— দেখলাম জলে ভাসছি— আবার যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম— সমুদ্রতটে আমি— তারপর থেকেই হাঁটছি-নিজেকে খুঁজছি— নিজের পরিচয় খুঁজছি— এই অপরিচিত ভূখণ্ডে আমি কি করছি? কি করে এলাম ?
১ম : আমিও— জান— আমিও— তোমারই মতো— শুধু মনে আছে একটা তীব্র জলোচ্ছাস একটা ঢেউ— আচ্ছা বলত— খাবার পেয়েছ? এখানে কিছু খাবার—
২য় : জানি না এটা খাবার কি-না কিন্তু আমি খেয়েছি—
১ম : কোথায় খাবার?
২য় : খেয়ে দেখতে পার— ওই যে গাছের তলায় ছড়িয়ে আছে, এটুকু বলতে পারি মৃত্যু হয়নি। আমার—
[১ম দৌড়ে ছুটে যায়। খাবার খায়]
১ম : আঃ— এবার আমি চিন্তাশক্তি ফিরে পেয়েছি। আরও খাবার চাই—
২য় : আসলে খিদে— আমাদের পশুত্বের কাছাকাছি নিয়ে যায়।
১ম : খাবার চাই— ভেতরে আগুন জ্বলছে। অবসন্ন হচ্ছে শরীর।
২য় : সেটা তোমার একার নয়— খিদে ধীরে ধীরে আমাকেও দুর্বল করছে। এসো দুজনে মিলেই খাবার খুঁজি কারণ সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
[ওরা হাঁটতে থাকে]
১ম : তোমার পোশাক আমার পোশাক কিন্তু এক নয়—
২য় : আমিও তাই দেখছি—
১ম : আমরা পোশাক পরে আছি কেন?
২য় : [নিজের দিকে তাকিয়ে] মনে হয় নিজেকে আড়াল করতে?
১ম : আড়াল করতে ?
২য় : কেন?
১ম : হতে পারে তীব্র শীত বা গরম থেকে বাঁচাতে... আমি ঠিক জানি না... ওই তো... একটা পশু। নিজেকে প্রস্তুত কর... ঝাঁপাতে হবে— ওটা দ্রুতগামী— চল— কি দেখছ মার মেরে ফেল না হলে উল্টে তোমাকেই [ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিহত পশুটির ছাল ছাড়িয়ে তার মাংস খেতে চায়।] ।
২য় : না— খেতে পারছি না। কিন্তু লোভ হচ্ছে, আসলে কাঁচা মাংস তো কখনও— একে পুড়িয়ে ফেলতে পারলেই—
১ম : কি করে জানলে?
২য় : পুড়িয়ে ফেলা?
১ম : না পুড়িয়ে ফেললে যে খেতে পারব সেটা কে বলল।
২য় : জানি না... হয়তো আমার ভেতরে এ জ্ঞানটা ছিল— মস্তিষ্কের কোন অংশে... উঃ কিছুই মনে হচ্ছে না।
[ওরা পুড়িয়ে ফেলে]।
১ম : পোড়া মাংস খুব সামান্য, তবু বেশ সুস্বাদু...
২য় : না এভাবে বসে থেকে সময় নষ্ট করলে চলবে না, খুঁজতে হবে— এখান থেকে বেরিয়ে যাবার রাস্তা খুঁজতে হবে।
১ম : আমরা যাচ্ছি কোথায়?
২য় : আমরা নয়— আমি, আমি খুঁজছি আমার বাসস্থান সেখানেই আমাকে পৌঁছতে হবে।
১ম : তুমি একা?
২য় : নিশ্চয়ই, সেখানে শুধুই আমি আমার পরিবার আমার মাটি...
১ম : তাহলে আমি কি খুঁজব?
২য় : সে আমি কি জানি।
১ম : হ্যাঁ, [ভাবতে থাকে] আমারও তো একটা বাসস্থান ছিল— যেখান থেকে আমি এখানে— কিন্তু সেটা কোথায় ?
২য় : সেটা কোথায় আমিও কি জানি— যদি জানতাম তাহলে আমিও কি— সেই খোঁজটাই তো আমার চলেছে। যখনই পাব আমি চলে যাব।
১ম : কিন্তু এই মুহূর্তে সেই জায়গাটা কোথায় আমরা জানি না। তবে যতক্ষণ না পাওয়া যাচ্ছে এখানেই, এই অচেনা পরিবেশেই জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
২য় : একটা প্রবল ঝাঁকুনি আমার স্মৃতিশক্তিটা দুর্বল করে দিয়েছে— তবে, সেটা ফিরে আসবেই—
১ম : কিন্তু তারপর কি করে সেখানে ফিরে যাবে?।
২য় : লক্ষ্য স্থির হয়ে গেলে– পৌঁছানোর পদ্ধতিটাও—
১ম : চারিদিকে অথৈ সমুদ্র...
২য় : তার মাঝখানে দিকভ্রান্ত আমি... মাথায় একটু জোর দিয়ে দেখি— যদি স্মৃতিটা ফিরে আসে।
১ম : এই ঝোপঝাড় পেরিয়ে কোথাও কি আছে মানুষের বেঁচে থাকার প্রমাণ? ধুর, নিজেকেই এখনও চিনতে পারছি না, এ যে কি যন্ত্রণা।
২য় : ইউরেকা— পেয়ে গেছি— আমি— আমার বাসস্থান ছবির মতো আমার চোখের সামনে। এমনি কোন এক সমুদ্রের ধারেই এক গ্রামে, আমার ছোট্ট সংসার— হ্যাঁ, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা— আর আমার পালিতকুকুর— ঘরের পেছনেই আমার চাষের খেত... হ্যাঁ দেখতে পাচ্ছি সেখানে গম-ভুট্টার সবুজ খেত হাওয়ায় দুলছে। মনে পড়েছে একটা প্রচণ্ড গরম হাওয়া বইছিল কদিন থেকে আমাদের গ্রামটার উপর দিয়ে। আমরা এনিয়ে গ্রাম সভায় আলোচনাও করছিলাম— আবহাওয়ার ওই পরিবর্তনকে নিয়ে... আমরা ভয় পাচ্ছিলাম এভাবে চলতে থাকলে আগামী মরশুমে সমস্ত ফসল নষ্ট হয়ে যাবে, আমরা এ আশঙ্কার কথা বলাবলি করছিলাম। আমরা কাকে দোষ দেব বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু উদ্বিগ্ন সমস্ত চাষীরা একে বিধাতার অভিশাপ বলছিল। বাড়ি ফিরছিলাম মনে একটা ভয় নিয়ে।
১ম : তারপর—
২য় : পরদিন, উজ্জ্বল আকাশ— আমার পুত্র সে বারান্দায় বই পড়ছিল— আমি, আমার স্ত্রী খেতের পচে যাওয়া ফসলগুলো তুলে তুলে ফেলে দিচ্ছিলাম— হঠাৎ
[চিৎকার করে কাঁদে]
১ম : কাঁদছ কেন ?
২য় : একটা ভয়ঙ্কর ঝড় ধেয়ে এল... আগুনের হল্কার মতো... আমি চোখের সামনে দেখলাম আমার স্বপ্নের বাড়িখানা টুকরো কাগজের মতো শূণ্যে মিলিয়ে গেল— তারপর একটা বিশাল ঝটকা— শরীরে তীব্র একটা যন্ত্রণা— ব্যস— কখন কিভাবে এখানে আমি জানি না— এখন আমি বুঝতে পারছি— আমি ওই বিপর্যয়ে আমার সব হারিয়েছি— আমার পুরো পরিবার। আমার যা কিছু সব৷
[১ম চিৎকার করে ওঠে]
১ম : তাহলে আমি কেন নিজের পরিচয় খুঁজে পাচ্ছি না?
২য় : পাবে— এখন সময়ের অপেক্ষা— আঘাত কার কতটা গুরুতর তার উপর নির্ভর করে তার স্মৃতি ফিরে আসার ব্যাপারটা ।... থাক, চল যাই।
১ম : কোথায়?
২য় : কি ভাবছ, বসে থেকে মৃত্যুকে আহ্বান করার কোন মানে হয় না। অন্ধকার বাড়ছে, কারণ সূর্য ঢাকা পড়েছে মেঘে।
১ম : [ও স্মৃতি হাতরাচ্ছে] সেদিনও সূর্য ঢাকা পড়েছিল এক ভয়ঙ্কর কালো মেঘে।
২য় : সেটা কোথায়?
১ম : বিশাল এক অট্টালিকার জানালায় বসে সে দৃশ্য আমি দেখেছিলাম।
২য় : তাহলে এবার তোমারও মনে পড়ছে।
১ম : কিছুটা... যদিও সবকিছু স্পষ্ট নয়— একটা বিরাট বড় ল্যাব... সেখানে আমার মতো আরও অনেকে একসঙ্গে গভীর গবেষণায় মত্ত...
২য় : জায়গাটা ঠিক কোথায়?
১ম : কোন এক সমুদ্রের ধার— আমরা আবিষ্কারের চেষ্টা চালাচ্ছিলাম কি করে লোহার খাঁচায় আর পাথর বালি মিশে তৈরি হবে বিশাল সব অট্টালিকা, যা প্রকৃতির উপর নিজের অধিকার সগর্বে ঘোষণা করবে।
২য় : এই কি তোমাদের কাজ?
১ম : হ্যাঁ ছিল। সবুজ বনভূমিতে আমরাই তো কত জনপদ তৈরি করেছি। তৈরি করেছি অসংখ্য বাঁধ... স্থাপত্যের নতুন নতুন আবিষ্কারের আমরাই তো পথিকৃৎ... কিন্তু সেদিন সেই সময় একটা অদ্ভুত বিভৎস কিছু ঘটল...
২য় : কি সেটা...
১ম : হ্যাঁ— একটা বিভৎস জলোচ্ছাস... গুড়গুড় শব্দে সবকিছু ভেঙে পড়ার আওয়াজ... সেই মুহূর্তে আমার শুধু মনে পড়ছিল আমার মা-বাবাকে... মনে হচ্ছিল এই বোধহয় পৃথিবীর শেষ ঘণ্টাধ্বনি—
২য় : তাহলে পৃথিবীটা সত্যি ভেঙেছে—
১ম : মনে হয়... না হলে আমি এখানে কোথায়—
২য় : একটা আস্তানা খোঁজা দরকার... আমি যাই—
১ম : আর আমি ?
২য় : তোমার দায় আমার নয়।
১ম : আমাকে ফেলেই...
২য় : তাহলে চল একসাথে এগিয়ে যাই, চলতে চলতেই শরীরের তাপ বাড়বে। তখন আস্তানা না পেলেও এভাবেই আরও কিছুক্ষণ বেঁচে থাকা সম্ভব।
[ওরা হাঁটতে শুরু করে]
১ম : বহুদিন পর উদ্দেশ্যহীন হাঁটছি... নাহলে জীবন তো ছিল মাপা— সময় ভাগ করা—
২য় : ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে... কোথাও জল পাওয়া যাবে?
[জল তেষ্টা বাড়ছে]
১ম : জল বস্তুটা যে এত মহার্ঘ্য আগে কোনদিন উপলব্ধি করিনি—
২য় : ওই যে দেখতে পাচ্ছ ওই যে পাতার ছায়ায়— চকচক করছে ওটা জল—
১ম : জল— [ওরা ছুটে যায়। জল খায়, এবার ১ম ফিরে এসেছে] পৃথিবীতে থাকলে ও জল ছুঁয়েও দেখতাম না—
২য় : ওটা জল না হলেও জলের মতোই কিছু একটা— উঃ আপাতত শান্তি...
১ম : দেখ। আকাশটা দেখ—
২য় : দেখলাম।
১ম : কী নীল।
২য় : আকাশ যে এমন নীল হতে পারে আজ জানলাম। আমরা পৃথিবী থেকে যে আকাশ দেখতাম সেটা ধূসর, আকাশের রং যে এমন নীল হয় তাইতো প্রথম জানলাম। আসলে ধোঁয়া যে কোন আকাশকেই বিবর্ণ করে দিতে পারে... তাই না? কি হলো ঘুমিয়ে পড়লে ? ভাল— ঘুম সমস্ত চিন্তা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।
২য় : না ঘুমোইনি— চেষ্টা করছিলাম— কিন্তু ঘুম আসবে না আমি জানি—
১ম : যদি ঘুমই না আসে এস তাহলে গল্প করি।
২য় : কি গল্প শোনাবে তুমি?
১ম : আমার নিজের কথা।
২য় : তোমার কথা আমি কেন শুনব?
১ম : শুনলে জানতে পারবে জীবন কত বিচিত্র।
২য় : তাহলে বল—
১ম : [গল্প বলে] অর্থের অভাব আমার কোনদিনই ছিল না। বরং বলতে পার যারা অর্থবান তাদের শ্রেণি বিভাগ হলে আমি অন্তত দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ব৷ উদ্দাম জীবন ছিল আমার যা চেয়েছি তাই পেয়েছি— প্রতি রাতে পোশাক পাল্টাবার মত নারী পাল্টেছি আমি৷ আমি জানি তারা কেউ আমায় ভালবাসত না ভ্রমরের মতো ছুটে আসত আমার বিত্তের টানে৷ আমরা যে ক্লাবের সভ্য ছিলাম— আমরা চূড়ান্ত আনন্দের জন্যে স্ত্রী পর্যন্ত পাল্টেছি— মাঝেমাঝে লংড্রাইভে চলে যেতাম সঙ্গে কার্টন ভর্তি হুইস্কি— কিন্তু তারপরেও বিষণ্ণতা, একাকিত্ব বাড়ছিল— ডাক্তার বলল অতিরিক্ত নেশা...
২য় : এতো সেই চেনা গল্প– উচ্চবিত্তের সমাজ—
১ম : না তা নয়...আসলে আমার যে ঘর ছিল না—
২য় : তোমার ঘর ছিল না?
১ম : হুঁ...ঘর—
২য় : কীসের অভাব ছিল তোমার—
১ম : হৃদয়ের—
২য় : মানে—
১ম : মানে যে ভালবাসায় একটা ঘর তৈরি হয়। আমার একরাতের কথোপকথন শুনলেই তুমি বুঝবে— সেদিন আমি একটু আগে ফিরেছি, কেউ নেই ঘরে— স্ত্রী প্রবেশ করেছেন—
১ম : এই ফিরলে—
স্ত্রী : হুঁ৷ ...খেয়েছ?
১ম : না আমিও এলাম... কি খাবার আছে?
স্ত্রী : তুমি দেখনি?
১ম : না।
স্ত্রী : আমিও তো ঠিক জানি না— প্রবালকে বলেছিলাম রেঁধে রাখতে।
১ম : ও,... তুমি খাবে?
স্ত্রী : আমি? না পার্টিতেই...
১ম : কার পার্টি?
স্ত্রী : মৃণাল বোসের বার্থ ডে।... ভাল খাইয়েছে-
[স্ত্রীর পা টলছে]
১ম : সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
স্ত্রী : বাজে বল না— আমি সোজা আছি— চার পেগে আমার কিছু হয় না।
১ম : এভাবে গাড়ি ড্রাইভ করা ঠিক না।
স্ত্রী : উফ্— উপদেশ একদম না...
১ম : বলছিলাম- রঞ্জা কোথায়?
স্ত্রী : ফেরেনি?
১ম : আমি তো তোমাকেই জিজ্ঞেস করছি?
স্ত্রী : আমাকে কেন জিজ্ঞেস করবে— এটা তোমার ডিউটি নয়—
১ম : তুমি মা?...এটুকু দায়িত্বও তুমি নেবে না?
স্ত্রী : মেয়ের সঙ্গে কখন ভাল করে কথা বলেছ? মেয়ে কেমন আছে তুমি জান?
১ম : মানে কি হয়েছে— ওর— কোথায় সে?
স্ত্রী : নার্সিংহোমে আজই তো ফেরার কথা— হয়তো ডাক্তার আটকে দিয়েছে...
১ম : নার্সিংহোম— কেন?
স্ত্রী : সব জান এটা জান না— কেন যুবতী মেয়েরা ওখানে যায়।
১ম : হেঁয়ালি না করে খুলে বল—
স্ত্রী : এভরসন্.. বুঝলে— স্বাধীনতা দিয়েছিলে... ফলটাও তো...
১ম : যার মা এমন— তার তো...
স্ত্রী : বাবা, ধোয়া তুলসী পাতা?... নরক— নরক—
১ম : সেই নরকের রানি তুমি—
২য় : [সহ্য করতে না পেরে] চুপ কর। উফ্, এ কেমন জীবন- অসহ্য...
১ম : তোমার জীবন তাহলে অন্যরকম?
২য় : একদম।... তুমি কখনও বীজ থেকে ফসলের জন্ম হতে দেখেছ?
১ম : না। আমরা তো শুধু খাদ্য হিসেবেই চিনেছি- খাবার টেবিলেই তার গুণাগুণ-
২য় : তাই সেই আনন্দ সেই অনুভূতি তুমি বুঝবে না। হারাভাঙা খাটুনির পর আমরা মাঠকে ফসলের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতাম। আগাছা বেছে নিতাম, চাষ করে মাটিকে নরম করে তুলতাম— তারপর একদিন উপযুক্ত সময়ে সেখানে পরিশোধিত বীজ ফেলতাম। আর অপেক্ষা করে থাকতাম অবিশ্রাম বৃষ্টির যার ছোঁয়ায় অঙ্কুরিত হবে ফসলের প্রথম আভাস। ধীরে ধীরে প্রতিদিন তার পরিবর্তন, সেই পরিবর্তনের সাক্ষী হতাম আমরা, চতুর্দিকের কিট-পতঙ্গের আক্রমন থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল তখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। সমস্ত আক্রমন থেকে তাকে রক্ষা করতে পারলেই তো সে সুস্থ থাকবে, ফলবতী হবে। তারপর একদিন সমস্ত প্রতিক্ষার অবসান করে আমাদের সমস্ত প্রত্যাশা পূর্ণ করে সে ফসলের জন্ম দেবে, সুস্থ সজীব টাটকা ফসল।
১ম : এতেও আনন্দ—
২য় : আনন্দ নয়? প্রকৃতি আর আমরা দুয়ে মিলে সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করতাম।
১ম : কিন্তু সবই তো পরের জন্যে— অন্যের উদর পূর্তির জন্যে—
২য় : সেখানেই তো আনন্দ দ্বিগুণ— আমরা ফসল ফলাচ্ছি বলেই মানুষ— তার উদরপূর্তির সঙ্গে বাসনাকেও তৃপ্ত করতে পারছে। অবশ্যি তোমার সেটা বোঝার কথা নয়— তোমার নিজের তৃপ্তির বাইরে কখনও—
১ম : সাবধান— ওইতো পেছনে একটা ছায়া।
[ঝোপের মাঝখান থেকে ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসে]
৩য় : না-না আমাকে বাঁচাও।
১ম : কে— কে— তুমি—
৩য় : শোন আমার চেহারা হয়তো তোমাদের থেকে আলাদা— কিন্তু আমি কারোযু ক্ষতি করতে আসিনি— বিশ্বাস কর।
২য় : তোমার চেহারাই প্রমাণ দিচ্ছে— তুমি শত্রু—
৩য় : বিশ্বাস কর— আমি তোমাদের মতোই অসহায়।
১ম : না ও শত্রু নয়।
২য় : কি করে সিদ্ধান্ত নিলে?
১ম : ওর চোখে মুখে যে অসহায়তার ছাপ ফুটে উঠেছে এতো মিথ্যে হতে পারে না।
৩য় : জান— আমি এতক্ষণ ওই মাটি খুড়ে খাবারের সন্ধান করছিলাম— তোমরা জান, ওই মাটি খাদ্য হিসাবে সুস্বাদু।।
২য় : মাটি কখনও খাবার হয়?
৩য় : হয় চেখে দেখলেই বুঝবে— আসলে এ মাটি আমার খুব চেনা—
১ম : কি করে?
৩য় : মাটি নিয়েই তো আমাদের কাজ, মানুষ যখনই মাটি ভেদ করে সম্পদের খোঁজ করেছে তখনই ডাক পড়েছে আমাদের, চিরকাল আমরাই তো তুলে এনেছি সভ্যতাকে সচল রাখার এগিয়ে নেবার মূল শক্তি তার জ্বালানীকে— বিনিময়ে আমরা কালো আরোও কালো হয়েছি... কিন্তু তারপরও যখন সেই ভাণ্ডারে টান পড়েছে তখনও মানুষ কোন নিষেধ না মেনে ছিঁড়ে খুঁড়ে বের করে নিতে চাইল সমস্ত সম্পদ। তখনই পৃথিবী তার ভয়ঙ্কর ভয়াল চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল... আর তুচ্ছ হয়ে গেল আমাদের অহংকার— আমাদের বিজ্ঞান।
২য় : তুমি আমাদের কথা প্যাঁচে জড়িয়ে আমাদের জন্যে যা কিছু অবিশষ্ট এখানে আছে তাতেও ভাগ বসাতে চাইছ... এখন বুঝতে পারছি তোমরাই-তোমরাই সেদিন আমাদের সর্বনাশের সূচনা করেছিলে।
১ম : না-ও- বেঁচে থাকার জন্যে ওদের হয়ে কাজ করেছে— ওকে ক্ষমা করে দাও— ও আজ্ঞাবহ শ্রমিক মাত্র।
৩য় : দেখ পৃথিবীর সমস্ত ঘৃণার চিহ্ন আমার শরীরে তাই আমি বিষাক্ত— পৃথিবী আমার শরীরে থুতু ছিটিয়েছে... দেখ... আমার মৃত্যু আসন্ন। আমাকে ক্ষমা কর...
২য় : আমরা তখন প্রতিবাদ করিনি— তাই ওই বিষ বাতাসে, খাদ্যে, মিশে আমাদের শরীরে।
১ম : এই যে অবসন্নতা তাওকি এই বিষক্রিয়ার ফল?
২য় : জানি না—
১ম : কিন্তু আমরা এখন কোথায়?
২য় : মনে হয় অন্যকোন গ্রহে— মহাপ্রলয়ের শেষে এখানে পৌঁছেছি।
৩য় : একি তবে নরক বা স্বর্গ।
২য় : জানি না যদি নরক বা স্বর্গ হয় তবে হতেও পারে বা কিন্তু গাছপালাতো রয়েছে যদিও তাদের বর্ণ হলদেটে।
১ম : কিন্তু— তাহলে দেবতা— অসুরেরা কই—
২য় : নাও হতে পারে— তবে শ্বাস নিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে না এও সত্যি—
৩য় : কিন্তু মাটি গাছপালা তো প্রায় পৃথিবীর মতোই—
২য় : হয়তো পৃথিবীর কাছাকাছি কোন গ্রহ, যার খোঁজ আমরা এখনও পাইনি— আচ্ছা এখান থেকে কি কোনদিন ফেরা যাবে?
১ম : কোথায়?
২য় : পৃথিবীতে।
১ম : যা ধ্বংস হয়ে গেছে—
২য় : কি করে বুঝলে?
১ম : ওই বিস্ফোরণের পর আর কিছু অবশিষ্ট থাকে?
৩য় : তাহলে এই হবে আমাদের নতুন ঠিকানা।
[১ম অস্থির]
১ম : এখানেই বাকি জীবন?
২য় : কি হলো অস্থির হচ্ছো কেন?
১ম : না মানে... সময় কাটছে না।
২য় : সময়ের কি প্রয়োজন এখানে?
১ম : তাতো সত্যি— সময়ের কিইবা মূল্য এখানে, কোন নিয়মের মধ্যেই তো আমরা আর বাঁধা নই।
৩য় : তবু... সময় বুঝতে না পারলে সময় যে বয়ে যাচ্ছে তাও তো বোঝা যাবে না— আর সময় যদি বয়ে না যায় তাহলে বাঁচাও তো অর্থহীন। [কাঠি দিয়ে মাটিতে দাগ দেয়] এই যে আমি দাগগুলো দিলাম, এই দাগ আলোর সাহায্যে সময়ের চলমানতাকে বুঝতে সাহায্য করবে।
২য় : কেন? দিন-রাত্রির পার্থক্যই তো সময়ের পরিবর্তন বোঝার পক্ষে যথেষ্ট।
৩য় : আর মাঝখানের অফুরন্ত সময়? সেই সময়টুকু ভাগ করা না থাকলে আমরা যে নির্জীব, অলস হয়ে পড়ব... মরার আগেই মরে যাব।
[১ম অবসন্ন হয়ে পড়ছে]
১ম : উঃ, জল চাই— আর একটু জল—
২য় : তাই— একটু জল পাওয়া যাবে?
৩য় : জল? এখানে জল নেই—
১ম : না— না আছে— আমরা পেয়েছিলাম—
২য় : সেটা জল কিনা হলফ করে বলা যাবে না।
১ম : মরে যখন যাইনি বুঝতে হবে ওটা জল ছিল— [বৃষ্টি নেবেছে]— আঃ—বৃষ্টি— [জল খায়]
৩ম : বৃষ্টি— এই গ্রহে বৃষ্টি!
২য় : পৃথিবীর কাছাকাছি তো, হয়তো তাই— কিন্তু শান্তি—
১ম : এই জলের জন্যেই দেশে একটা যুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি হচ্ছিল। জলের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দেশের সঙ্গে অন্য দেশের তিক্ততা বেড়েই চলছিল।
২য় : এই জলের জন্যে কোথাও হাহাকার কোথাও বন্যা, বিপর্যয়।
১ম : ধ্বংস যে আসন্ন প্রকৃতি কিন্তু সে বার্তা দিচ্ছিল— কিন্তু আমরা কেউ বুঝতে পারিনি।
২য় : বা বুঝতে চাইনি।
[নীরবতা]
৩য় : অন্ধকার করছে—
২য় : চল— এবার একটা আস্তানা গড়ি। যা আমাদের সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করবে।
৩য় : হ্যাঁ, প্রয়োজনটা বাড়ছে৷
২য় : এখানে, এই দিকটার একটা অংশ আমি আলাদা করে দাগ দিয়ে নিচ্ছি। যেখানে কোনদিন আমার বংশজরা বা আমার স্বধর্মীরা আর স্বজাতিরা বসবাস করতে পারবে।
১ম : আশ্চর্য, এখানে প্রতি মুহূর্তে প্রাণ সংশয়, তবু জাত তবু ধর্ম?
২য় : [লজ্জা পায়] না— না— আসলে একটা নিরাপত্তাহীনতা আমার রক্তে, আমার চরিত্রে মিশে গেছে তাই বারবার একই ভুল করি।।
৩য় : চল, যাবে?
২য় : কোথায়?
৩য় : ওই দিকের শেষ প্রান্তে।
১ম : কি আছে ওখানে—
৩য় : শোন, আমি দেখেছি— একটা উল্টে থাকা নৌকো, একটা কঙ্কাল
১ম : ও।
তয় : আরও দেখেছি একখানা প্লাস্টিকের তাবু—
২য় : তার মানে ওই প্লাস্টিকের আর কোন দাবীদার নেই— আমরাই... তাহলে আপাততঃ একটা মাথা গোজার ব্যবস্থা হচ্ছে—
১ম : না।
২য় : না?
১ম : পৃথিবী ধ্বংসের একটা অস্ত্র ওটা, এখানে একে প্রশ্রয় দিও না।
৩য় : তার মানে নিরাপদ আশ্রয়ের এমন সুযোগ আমরা হাতের কাছে পেয়েও হারাব?
১ম : ভুল কর না, ও হচ্ছে পৃথিবীর পাপ।
৩য় : নিশ্চিত আরামের এমন সুযোগ অথচ আমরা—
১ম : আমরা চিরকাল শুধু স্বার্থপরের মত নিজের কথা ভেবেছি— একবারও তাকাইনি আমার চারপাশটা কেমন আছে— জানতেও চাইনি—
২য় : তাহলে কি করব আমরা?
১ম : হোক্ না বাঁশ-পাতার ঘর।
২য় : বাঁশ-পাতা কি প্লাস্টিকের বিকল্প হতে পারে— ওকি দিতে পারে নিরাপত্তা—
১ম : সব সুখ নাই বা পেলাম।
৩য় : এতো বিজ্ঞানের সঙ্গে সোজা লড়াই—
১ম : করতেই হবে... একবার যখন জাল ছিঁড়ে বেড়িয়েছি—
২য় : আমি বলি কি... তারচেয়ে হোক্ না বিজ্ঞানের সঙ্গে সহাবস্থান।
১ম : মানে—
২য় : এবার বিজ্ঞান হোক্ প্রকৃতির সহায়ক, এবার আর বিজ্ঞান ও প্রকৃতির লড়াই নয়। প্রযুক্তির ব্যবহার আমরা নতুন করে করব প্রকৃতির নিয়ম মেনেই—
৩য় : তাই হোক্— আমরা একে অন্যের হাত ধরে প্রকৃতির মাঝেই বাঁচব। আমাদের প্রয়োজন হোক্ সীমিত— এই হোক্ আমাদের অঙ্গীকার। ।
২য় : অন্য পৃথিবীটা তৈরি হোক্, পুরোনো সব ভুলগুলোর থেকে শিক্ষা নিয়েই।
১ম : এখানে আরও যারা বেঁচে আছে— চল প্রথমে তাদের খোঁজ করি— তাদের সবাইকে নিয়েই— চল—
[ওরা এগিয়ে যায়]
৩য় : এস— ওই তো পথ— দেখ দেখ— অযত্নে লালিত— ওই গাছগুলো কেমন ফলবতী হয়ে আছে— আমাদের অপেক্ষায়— নাও কুড়িয়ে নাও সব ফল।
১ম : ওই শোন প্রকৃতির গান—
২য় : এ গান তো আমরা আগে শুনতে পাইনি, কেন?
১ম : আমরা যে তখন আমাদের হৃদয়ের দ্বার বন্ধ করে রেখেছিলাম।
[হঠাৎ একটা রিং বেজে ওঠে, ১ম ছুটে গিয়ে
পড়ে থাকা একটা মোবাইল তুলে নেয়]
১ম : হ্যালো পৃথিবী— পৃথিবী বেঁচে আছ... কি?
[২য় ওর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়।]
২য় : কি... হ্যাঁ-হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি— কি আমরা একটা দ্বীপে আটকে আছি?... এটা কোন গ্রহ নয়?— সেটেলাইটে আমাদের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে?
[এবার ১ম মোবাইল হাতে নেয়]
১ম : আর পৃথিবী?... আছে?... কি সমুদ্রের ধারে সব নগরী গ্রাম জনপদ সব চলে গেছে সমুদ্রের তলায়... বাকি পৃথিবী?... এখনও বেঁচে আছে?
[৩য় এবার মোবাইল হাতে নেয়]
[ওরা চিৎকার করছে]
৩য় : শুনছ,... আমাদের নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা কর... আমরা এখনও প্রাণে বেঁচে আছি।
[মোবাইল অন্য হাতে]
২য় : সভ্যতার কাছে আমাদের নিয়ে যাও।
১ম : শোন, বাকি পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখার এক মন্ত্র আমরা পেয়েছি... সমস্ত অরণ্য জুড়ে আমরা সে গানই শুনতে পাচ্ছি, তোমাদেরও শোনাব সে গান— আমাদের নিয়ে যাও—