সাহিত্য পত্র
গল্প - নীল বসন্তে তৃষা
দেবশ্রী চৌধুরী
২১ মার্চ ২০২২
এই সংখ্যার পঞ্চম ছোটগল্প

সকাল থেকেই ন.ব. কলেজ চত্বরে অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি ভীড়, আর হবে নাই বা কেন ? দুদিন পরেই যে বসন্ত উৎসব পালন হবে কলেজে আর প্রত্যেক বারের মতো এবারেও বিভিন্ন কার্যসূচী থাকায় ছাত্রদের মধ্যে উৎসাহ লাগামহীন। বস্তুত ন.ব. কলেজের বসন্ত উৎসবে সাবেকী ও বর্তমান যুগের অদ্ভুত সংমিশ্রণের ফলে এর মানটাই আলাদা। কিন্তু এই উৎসবের মধ্যেও তৃষার মনে আনন্দ নেই। তাই সে এতকিছুর মধ্যেও মনমরা হয়ে বারান্দার এক কোনায় বসে রয়েছে।
নীলের সাথে কথা নেই, পুরো দশদিন হয়ে গেছে। মোবাইল ফোনটাকে পঞ্চান্ন নম্বর বার ব্যাগ থেকে বের করে দেখল, "নাঃ বিশেষ লাভ নেই, কিছুই তো এলো না এখনো "।
ফোনটাকে ব্যাগের ভেতরে রাখতে গিয়েই হঠাৎ করে বেজে উঠল, নম্বরটা অচেনা। হ্যালো বলতেই একটা চেনা সুর ভেসে উঠলো। "তৃষা ম্যাডাম নিকি ? আমি নীল বলছি।"
গলা শূনে তৃষা অবাক ! খুব খুশি হলো, তাও নিজেকে যতটা পারে শান্ত রেখে বললো "নীল তুই ?"
নীল বললো "হ্যাঁ আমি, কিরকম আছিস তুই ? আমাকে ব্লক করলি কেন ?
তৃষা বললো " জানিনা "
নীল বললো " জানি না মানে ? "
তৃষা বললো " রাখছি নীল। ক্লাস আছে। আমি যাচ্ছি "
নীল শান্ত গলায় বললো
" বিকেলে দেখা করার আছে। তুই আসিস। আমি ক্যান্টিনের সামনে তোর জন্য অপেক্ষা করবো। "
তৃষা ন.ব. কলেজের ডিগ্রী প্রথম বছরের ছাত্র আর নীল ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। তৃষার পুরো নাম তৃষা সমাদ্দার, দেখতে ছোটখাটো, রঙ শ্যামবর্ণ, গোলগাল। অন্যদিকে নীলের পুরো নাম নীল প্রামাণিক, লম্বায় ছয় ফুট।
তৃষা আর নীলের প্রথম দেখা কলেজ সোশ্যাল উইকএ। দেখার থেকে ভালোবাসায় গড়াতে বেশি সময় লাগে নি। সব কিছু ঠিকই চলছিল কিন্তু বাধ সাধলো নীলের প্লেসমেন্ট। ফাইনাল ইয়ারে হবার সুবাদে প্লেসমেন্টে বসে ছিল নীল, আর ক্লাসের টপার হওয়ায় ভালো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিও হয়ে গেলে তাঁর, তাও একটাতে নয়-- দু দুটোয়। কিন্তু সমস্যা এখানেই দেখা দিল। দুটোই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, শুধু প্যাকেজের ফারাক। কম প্যাকেজের চাকরিটা কোলকাতায় আর বেশি প্যাকেজের চাকরিটা দিল্লির, আর ঠিক এখানেই তৃষার আপত্তি। নীলের ইচ্ছে দিল্লির চাকরির অফারটি নেওয়ার, আর তৃষা চায় কোলকাতাতেই থাকুক নীল। এই নিয়ে কত তকবিতর্ক, বিগত পনের দিন যাবদ।
বিকেল বেলা ঠিক সাড়ে চারটা নাগাদ তৃষা এসে পৌঁছল ক্যান্টিনের সামনে, এসে দেখলো নীল আগের থেকে বনোয়ারি লালের পানের দোকানের সামনে দাড়িয়ে সিগারেট হাতে মোবাইল দেখছে।
তৃষাকে দেখে এগিয়ে এলো নীল। মোটে দশদিন হলো তৃষার সঙ্গে কথা বন্ধ হওয়ার, এরই মধ্যে নীলের মনে হলো কত যুগ হয়ে গেল তৃষাকে সে দেখে নি।
কাছে এসে বললো " তুই ভালো আছিস? "
তৃষা ছোট করে উত্তর দিল " হ্যাঁ ভালো আছি।"
নীল বুঝলো এই ভালো আছিটা ভালো না থাকারই ইংগিত। মনে মনে ভাবলো এখনও রাগ কমেনি ওর। তাও মুখে হাসি টেনে এনে বললো " খুব রাগ হয়েছে না, তোর ? "
তৃষা বললো " নাঃ তো, আমি ঠিক আছি। "
এবারও বুঝলো নীল, মন গলানো গেল না তৃষার। একটু থেমে বললো " শোন, দিল্লির চাকরিটা আমাদের দুজনের ফিউচারটাকে সিকিওর করবে। বোঝার চেষ্টা কর। "
তৃষা বললো " শোন নীল, শুধু টাকা টাকা করিস না, টাকা কম থাকুক তাও তো শান্তি আছে। আমাদের জীবনে কখন কি হয়, আমরা কি কেউ কখনো বলতে পারি? কাকু কাকিমাদের বয়স হয়েছে, ওদের সাথেও তো থাকাটা দরকার, ওদের তোকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে।
নীল ঠাট্টার সুরে বললো, " আর তোর হবে না ? "
তৃষা একটু থেমে বললো " সত্যি বলতে আমারও হবে কিন্তু তুই তো ........." বলে চুপ করে রইলো তৃষা।
নীল শান্ত হয়ে দেখতে লাগলো তৃষাকে।
তৃষা ব্যস্ত হয়ে নীলকে বললো, " সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে নীল। আমি বাড়ির দিকে এগোলাম " বলে হাঁটা দিল তৃষা, কিন্তু পরক্ষনেই আবার ফিরে এসে বললো, " আর তোকে আনব্লক করেছি। ভাবলাম আর তো কিছু দিনের মধ্যে চলেই যাবি তাই যতোদিন এখানে আছিস ততদিন ভালো করে সময় কাটাই। "
রাতে খাবার টেবিলে নীলের মা, মিসেস প্রামাণিক লক্ষ্য করলেন যে নীল খুব গভীর চিন্তায় মগ্ন। কাছে গিয়ে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, " কি হয়েছে নীল ? আমি তোর মা। আমার থেকে লুকোস না। বল। "
নীল বললো, " কই, কিছু না তো। "
মা বললেন " কিছু তো আছেই। বলেই দেখ না "
নীল চুপ করে রইলো। নীলকে চুপ করে থাকতে দেখে নীলের মা আবারও বললেন, " দেখ নীল, এতো বেশি ভাবিস না। "
নীল বললো " মা, আমি দিল্লির চাকরিটা নিতে চাই কিন্তু কোলকাতা ছেড়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে ? "
মা হেসে বললেন, " দেখ জীবনে সবকিছু পাওয়া যায় না নীল। আবার বেশি চাওয়া পাওয়ার পেছনে ছুটতে থাকলে হঠাৎ একদিন পেছন ফিরে দেখবি তুই অনেক এগিয়ে গেছিস বাকি দের কে পেছনে ফেলে। যা ডিসিশন নিবি ভেবে চিনতে নিস। "
নীল কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে ডোরবেল বেজে উঠলো। নীলের মা গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন, উলটো দিকের বাড়ির মিস্টার দত্ত খুব চিন্তীত মূখে বলছেন, " পাড়ার মিস্টার দাশগুপ্তের হঠাৎ খুব শরীর খারাপ করেছে। বোধহয় হাসপাতালে শিগগিরই নিয়ে যেতে হবে। এদিকে আমার গাড়ির ড্রাইভার দুদিনের ছুটিতে বাড়ি গেছে, তাই বলছিলাম আপনাদের ড্রাইভার কে যদি পাওয়া যেত। "
নীলের মা বার কয়েক ফোন লাগালেন কিন্তু কোন লাভ হলো না। নীলের বাবার ও শরীরটা ভালো নেই তাই উনাকে জিজ্ঞাসা করবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় নীল এসে বললো, " আমি তো গাড়ি চালাতে পারি, আমি যাচ্ছি। " বলে ওদের সাথে বেরিয়ে পড়লো।
হসপিটালের সব ফর্মালিটিস শেষ করে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালো নীল। মার কথা, তৃষার কথা ভাবতে ভাবতে এবং মিস্টার দাশগুপ্তকে দেখে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল নীল, হোক টাকা কম, তাও মা, বাপী, তৃষা কে ফেলে সে কখনো ই যাবে না। মিস্টার দাশগুপ্ত বিপত্নীক, একমাত্র ছেলে থাকে বাইরে, আজ তার পাশে তার পরিবারের কেউই নেই। এই বোধহয় জীবন !!
নীল ফোন বের করে কল করলো তৃষা কে। ঘুমের চোখে নীলের ফোন দেখে হকচকিয়ে গেল তৃষা, রাত বাজে 2 টো !! এতো রাতে নীলের ফোন !! ফোন ধরতেই নীল বললো, " তৃষা আমি বলছি, নীল। "
আর কিছু বলার আগেই তৃষা বললো, " সব ঠিক আছে তো ? এতো রাতে ফোন করলি যে ? "
নীল হেসে বললো " আমি কলকাতার চাকরিটা ই নেবো ভাবছি, আর এটা আমার ফাইনাল ডিসিশন। তুই ঠিকই বলেছিলি, টাকাটা কখনোই জীবনের সব না। "
তৃষা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললো " সত্যি জাবি না ? "
নীল বললো " নাঃ, "
"love you নীল"
নীল হেসে বললো, " Love you too "।
তৃষা বললো " এই নীল, আজ কলেজে বসন্ত উৎসব না ? "
নীল ভাবলো, তাইতো ! বললো, " তৃষা, বসন্ত এসে গেছে, "
তৃষা মূচকী হেসে বললো, " তাইতো দেখছি !!!! "