সাহিত্য পত্র
অমর ঊনিশ
জয়রাজ পাল

চাকচিক্যময় সময়ের উন্মেষ ঘটিয়ে
সমস্ত শহরজুড়ে বর্তমানের বিষাদগন্ধ
আর অতীতের বিস্ময়মৃত্যু নিয়ে চলতে চলতে;
নিত্যদিনের শুভ্র ধ্রুবতারায়, ঘন কুয়াশায়, শূন্য নীলাম্বরে
যতবার নবজাগরণের রশ্মিটিকা এঁকে গেছে-
যুগ যুগান্তরের পল্লবে-অক্ষরে বর্ণপরিচয়, কিশলয় ও সহজপাঠের
মহাজাগতিক ইতিহাস লিখে যাওয়া এই বাংলা ভাষা...
আমি ততবার স্পষ্ট দেখেছি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত
শহিদ মিনারে বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে থাকা কত কত স্বপ্নলীন শরীর!
অবিরত শুনেছি সেইসব সবুজ প্রাণেদের শিরা-উপশিরা জুড়ে
শীর্ণধারায় বয়ে যাওয়া রক্তাক্ত বুলেটের মর্মভেদী হুংকার!
এমনকি আমার কল্পনার নির্ভেজাল পরিস্ফুটনে,
বাস্তবের অবিচ্ছেদ্য অন্তস্তলে, হাসি-কান্নার ঘোরলাগা মেহেফিলে
ততবার মৃত্যুসম সব দুর্যোগের আঁধার কাটিয়ে
উদীয়মান সূর্যের মতো ভেসে উঠেছে....
ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার পুঞ্জীভূত রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে
অকালে ঝরে যাওয়া হাজার হাজার অতৃপ্ত আত্মারা।
আসলে আমি শুনিনি বরাকের মৃত্তিকায় সেদিনের
সমস্বরে প্রতিধ্বনিত লাঞ্ছনাময় কান্না,
দেখিনি অহং দৌরাত্ম্যের পাথর ভাঙতে ভাঙতে
অঘটন উল্লাসে উপচে পড়া রক্তের স্রোত।
তবে নিজের জীবনের প্রতিটা সাফল্য থেকে শুরু করে প্রতিটা বিষাদী প্রাতে,
মনভাঙা রাতে সঞ্জীবনী মন্ত্রের মতো বারবার স্মরণ করেছি
অন্তরাত্মার সেই অশ্রুসিক্ত ইতিহাসকে।
কারণ সুধাময়ী রত্নগর্ভার বুকে সাম্যবাদী চেতনার জন্ম দিতে
সেদিন ঝাঁকে ঝাঁকে চলেছিল গুলি, অগণিত পড়েছিল একের পর এক লাশ;
নিজের ধূসর দৃষ্টির, শ্রবণ শক্তির, বাক্য-ধ্বনির প্রাপ্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে...
সেদিন উত্তাল মিছিলে, সমবেত আন্দোলনে গর্জে উঠেছিল
অসমের দক্ষিণ সীমার অভিন্ন সত্তা।
তারপর বীর সেনানীর মতো লাশ-রক্ত-আগুনের বিকৃত আবরণ ভেঙে
অনেকটা দুর হেঁটে এসে,
রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আবদ্ধ হয়ে বরণ করেছিল শাহাদত,
হাসিমুখে জয় করেছিল গর্বের মাতৃভাষা।
তারপর অবহেলায়, সমালোচনায় কেটে গেছে বহুদিন,
পার হয়ে গেছে বহুরাত;
শত্রুর বুকের উপর মস্তক উঁচিয়ে, শিরদাঁড়া সোজা রেখে
ঝাঁপিয়ে পড়া সেই দুর্বার সাহস আজ পরিণত হয়েছে সাবালকে।
যুগ যুগান্তরের ক্রমবর্ধমান ধারায় ধরে রাখা সাবেকী সেই সম্মান,
বিমূর্ত সেই ঐতিহ্য, বিশুদ্ধ সেই লড়াই....
বিলাসী কর্মযজ্ঞের অন্তরালে আজ হয়েছে ক্ষীণ।
তবুও থামেনি কৃষ্ণচূড়া মাখা বর্ণমালায় বিলি কাটা প্রতিবাদী কলম,
থামেনি শহিদের রক্তে রাঙা রাজপথে চেঁচিয়ে উঠা বারুদঝরা কন্ঠ।
ক্ষমতার উচ্চবেদী কাঁপিয়ে মৃদঙ্গ গর্জনে যেন আজও বেজে চলেছে
সেই রুদ্র মহাগীত, চিরনবীন উন্মাদনায় জ্বলছে সেই অশ্রুধৌত অগ্নিশিখা।
মনে হচ্ছে মধুরতম এই বিশ্বের দ্বারে দ্বারে
সকল নিমজ্জিত অহংকারের প্রতি প্রয়োজনানুসারে রুখে দাঁড়াতে-
নিজ সত্তার সমস্ত শালীনতা বজায় রেখে পুনর্বার ফিরে আসবে
অস্তিত্ব রক্ষার সেই চিরস্মরণীয় লড়াই,
মাতৃত্বের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে বিশ্বের দরবারে প্রকাশ করতে
আকাশে-বাতাসে হোমাগ্নি মিশিয়ে স্বমহিমায় ফিরে আসবে অন্য কোনো 'অমর উনিশ'।।