সাহিত্য পত্র
বালিকার মুখ
নির্মল হালদার

আমার সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে আছে এক বালিকা।
আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি, কিছু নেই।
বালিকার হাত ধরে বললাম-------চল্ আমার বাড়িতে।
সে না না করে। আমি বললাম-----ভয় নেই তোর চল্ -----তোকে মুড়ি দেবো।
গুড়--মুড়ি খেতে চাইলেও দিতে পারি।
অনেকবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বালিকাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি।
যদিও তার জড়োসড়ো ভাব কাটছে না। মাকে বললাম, গুড় মুড়ি দেবার জন্য।
মা বললো, গুড়তো নেই, মুড়ির সঙ্গে ছোলা ভাজা দিতে পারি।
বালিকার মলিন মুখের দিকে চেয়ে মনে হলো, এই আমার দেশ।
এদের রক্ষা করতে আমরা পারিনা।
আমরা এদের ভিখারি সাজাই। অথবা ভিখারি তৈরি করি।
বালিকা বারান্দায় বসে নিচু মুখে মুড়ি খেতে খেতে লক্ষ্য করছে, খেলনা ট্রেনের দিকে।
পছন্দ হয়েছে বুঝতে পারছি। বালিকাকে বললাম, ওই খেলনা ট্রেন তোর লাগবে?
সে চুপচাপ থাকে। আমার দিকে চেয়ে রয়। আমি বললাম, তোকে ট্রেনটা দিয়ে দেবো।
তার আগে ওই ট্রেনে করে আমরা ঘুরে আসি চল্------।
খেলনা ট্রেন আমার ছোট ভাইপোর। সে এখনই চাইলে দিতে হবে।
ঝটপট তাই বালিকাকে নিয়ে ট্রেনে উঠে বসেছি।
টিকিট কাটা হয়নি। না-হোক। আপাতত ঘুরে আসি।
ধানচাটানি হয়ে উশুলডুংরি। পাহাড় ঘেরা গ্রাম।
যে কোনো একটা গ্রামে নেমে পুতুলের সঙ্গে দেখা করবো।
আমার সেই কাঠের পুতুল। বিয়ে হয়েছে বাঁশিটাঁড়ে।
সে আমাদের দেখে খুশি হবে খুব। আমাদের খাওয়াবে নাড়ু।
একটা স্টেশন থেকে একজন হকার উঠলো।
সে বিক্রি করছে কাগজের পুতুল। তেঁতুলের আচার।
আমি বালিকার জন্য কিনে ফেললাম। তার চোখে মুখে হাসির ঝিলিক।
সে তেঁতুলের আচার খেতেও শুরু করলো। আমার জিভে জল।
তার কাছ থেকে খানিক নিয়ে জিভে দিয়েছি যেই, কি টক। কি টক।
তবুও ভালো লাগছে। কেননা, অনেকদিন বাদে ঘুরতে বেরিয়েছি।
ধানচাটানির কাছে এসে দেখলাম সূর্যাস্ত হচ্ছে।
তার রঙের বিভায় আমার মনে হলো, ঘরে ফিরবো না আর।
বালিকাকে নিয়ে থেকে যাবো কোথাও।
বালিকাও ট্রেনের জানালা থেকে দু'চোখ ভরে দেখছে নানান দৃশ্য। সেও খুশি খুব।
দুপুর পার হয়ে যায়। খিদে এসেছে। যা আসে প্রতিদিনের মত।
বালিকাকে শুধাই------তোর খিদে পাচ্ছে। সে ঘাড় নাড়ে।
ট্রেন কে বললাম-----চলো ঘরের দিকে।
জোরে জোরে হাঁক পাড়ি-----মা মা আমাদের খিদে পেয়েছে । খেতে দাও।
খিদেই তো আমার দেশ। ক্ষুধা তৃষ্ণা আমার দেশ।
এই বালিকা আমার দেশ।
এই বালিকাকে আমি শুধু খেলনা ট্রেনে তুলে বেড়াতে নিয়ে যাবো।
তার বেশি কিছু করবো না।
এই বালিকাকে আমি শুধু গুড়--মুড়ি খাওয়াবো।
সেই সঙ্গে বালিকার হাতে গুঁজে দেবো কয়েকটা টাকা।
আর ভুলে যাবো বালিকার মুখ। আমার দেশের মুখ।