বিজ্ঞান বিষয়ক
ভারতে বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে রমন এফেক্ট এক অবিস্মরণীয় ঘটনা
হিল্লোল ভট্টাচার্য
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
জাতীয় বিজ্ঞান দিবস উপলক্ষে এই লেখাটি লিখেছেন গণবিজ্ঞান আন্দোলনের একজন নিরলস সৈনিক হিল্লোল ভট্টাচার্য ...

ঊনবিংশ শতাব্দী ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবজ্জ্বল স্বর্ণযুগ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে, ঐ সময়ে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় অনুশাসন, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের অচলায়তন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নবজাগরণের মধ্য দিয়ে এদেশে জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। সেই সামাজিক প্রেক্ষাপটে জন্ম হয় একদল বরেণ্য বিজ্ঞানীর- যাঁরা মানবতাবাদের অনন্য নজির স্থাপন করে ভারতবর্ষের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন।
ভারতে অক্ষয় কুমার দত্ত এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্র বিজ্ঞান চিন্তা প্রসারের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন। এই ধারাবাহিকতাতেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ১৮৭৬ সালে ডঃ মহেন্দ্র লাল সরকারের অদম্য কর্মপ্রচেষ্টায় ' ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স' প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠান পরাধীন ভারতে বিজ্ঞানের বহু দিকপালকে উপহার দিয়েছিল - যাদের মধ্যে ১৯৩০ সালে এদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন উল্লেখযোগ্য। তাঁর আবিষ্কৃত ‘রমন এফেক্ট বা ‘রমন-প্রভাব’ পদার্থবিজ্ঞানের জগতে এক আশ্চর্য মাইলফলক হয়ে আছে। ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এই আবিষ্কারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়েছিল। রমন-প্রভাব আবিষ্কারের জন্য সি ভি রমন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩০ সালে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে তিনিই হলেন বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী। তাঁর নোবেল-বিজয়ী গবেষণার সব টুকুই সম্পন্ন হয়েছিল কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর ছোট্ট একটা গবেষণাগারে।
১৯২১ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি কংগ্রেস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে যোগ দেন রমন। এটাই রমনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। কয়েক দিনের এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণেই তাঁর সঙ্গে দেখা হল থমসন, রাদারফোর্ড, ব্র্যাগ সহ আরও অনেক বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর।
জাহাজে করে লন্ডনে যাওয়া আসার পথে বিশাল সমুদ্রের রূপ দেখে মুগ্ধতার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল রমনের মন। গভীর সমুদ্রের রঙ দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল এই ঘন নীল রঙের প্রকৃত রহস্য কী? ইতিপূর্বে লর্ড রেলেই আকাশের নীল রঙের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন অণুর সাথে আলোর কণার বিক্ষেপণের ফলে নীল বর্ণের আলোক তরঙ্গ বেশি দেখা যায় বলেই দিনের বেলায় আকাশের রঙ নীল। সমুদ্রের নীল রঙ সম্পর্কে লর্ড রেলেইর তত্ত্ব বেশ সরল। তাঁর মতে সমুদ্রের রঙ আসলে সমুদ্রের জলে আকাশের রঙের প্রতিফলন। রমন লর্ড রেলেইর এ তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত করেন জাহাজে বসে করা কয়েকটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে। একটি পোলারাইজিং প্রিজমের মাধ্যমে সমুদ্রের জলে আকাশের প্রতিফলন আড়াল করার পরেও দেখা গেল সমুদ্রের জলের রঙ ঘন নীল–যেন জলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নীল রঙ। ফলে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সমুদ্রের জলের নীল রঙ আকাশের রঙের প্রতিফলন নয়, জলে আলোককণার বিক্ষেপণের ফল। তিনি সমুদ্রের বিভিন্ন গভীরতা থেকে জল সংগ্রহ করে বোতল ভর্তি করে নিয়ে আসেন কলকাতায়। প্রিজম, টেলিস্কোপ ইত্যাদি নিয়ে গভীর সমুদ্রে রঙের খেলা পর্যবেক্ষণ করতে করতে অনেক উপাত্ত সংগ্রহ করেন রমন। কলকাতায় ফিরে এসে তরল পদার্থে এক্স-রে এবং দৃশ্যমান আলোকের বিক্ষেপণ সংক্রান্ত গবেষণায় মেতে ওঠেন তিনি। সেই গবেষণার ধারাবাহিকতাতেই আবিষ্কার হয় রমন এফেক্ট।
রমন এফেক্ট আলোকতরঙ্গের অজানা পথ খুলে দিয়েছে। শক্তির স্তর এবং অণু ও পরমাণুর গঠন বুঝতে অনেক সহায়তা করেছে। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখায় রমন এফেক্ট কাজে লাগছে। জীববিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও অনেক শাখায় রমন এফেক্ট কাজে লাগিয়ে অনেক নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। রমন এফেক্ট আবিষ্কারের দিনটিকেই জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে পালন করা হয়।