বিজ্ঞান বিষয়ক
বর্ধমানের পাখি – নোটবুক ‘অভয়কানন’
অভিজিৎ মিত্র
(দুই পর্ব একসাথে)
১৯ - ২৬ এপ্রিল ২০২১
অভিজিৎ মিত্র আই-আই-টি গুয়াহাটির প্রাক্তন অধ্যাপক এবং
বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যক্ষ।
তার গবেষনার মুখ্য বিষয় হল মোবাইল কমিউনিকেশন এবং সিগনাল প্রসেসিং।
কিন্তু ভাললাগা ও ভালবাসার বিষয় হল প্রকৃতি ও সাহিত্য চর্চা।
কৌরব অনলাইন পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন বহুবছর।
প্রকাশিত কবিতার বই তিনটি ও সম্পাদিত কবিতার বই একটি।
ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটির একজন কর্মী।
সাহিত্য ও গবেষনাপত্রের পাশাপাশি লেখক বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্য ইংরাজি ও বাংলায় বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখতে পছন্দ করেন। তার বিজ্ঞানধর্মী প্রবন্ধ বিগত প্রায় দেড় দশকের বিভিন্ন সময় Everyman’s Science, Breakthrough,
প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী, সাময়িক প্রসঙ্গ, সংবাদ প্রভাতী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

পর্ব ১
করোনা ভাইরাসের দৌরাত্মে ১৪ই মার্চ ২০২০ থেকে কলেজ-ইউনিভার্সিটি বন্ধ এবং রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার মিলিয়ে ৬৮ দিন পুরো লকডাউন থাকার জন্য ঘরে বসে নিবিড় পড়াশুনো ছাড়াও আরেকটা সুবিধে হয়েছিল। অনেকদিন পর প্রকৃতির সঙ্গে একান্তভাবে মেশার সুবিধে। এমনিতেই আমরা যে জায়গায় থাকি, সেটা প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। বর্ধমান ইউনিভার্সিটির বোরহাটে অবস্থিত অফিসার্স কলোনি, অভয়কানন। প্রায় পাঁচ একর জায়গার ওপর এই কলোনি অনেকটাই যেন বর্ধমানের ওয়েসিস। পানাপুকুর হনুমান সারি সারি কলা মেহগনি সেগুন আম জাম জামরুল কাঁঠাল পেয়ারা বেল নিম শিরীষ শিমূল কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া দেবদারু ঝাউ সোনাঝুরি তাল গন্ধরাজ চাঁপা করবী কল্কে রঙ্গন জবা মরসুমি-ফুল, কি নেই এখানে! সারাদিন পাখির কিচিরমিচির। অথচ আশ্চর্য এটাই যে এতদিন পাশাপাশি থাকার পরেও কখনো এত গভীরভাবে দেখার ইচ্ছে অনুভব করিনি। সারাদিন কাজ নিয়ে মেতে থাকতাম। এবার করোনায় বন্দী আমার মনে দশ বছর আগের জঙ্গলের প্রতি টান আবার যেন জেগে উঠল। আবার কোকিল দোয়েল টিয়ার কিচমিচের প্রেমে পড়লাম। মনে পড়ল দশ বছর আগে আইআইটি গুয়াহাটির ঝিলের ধারে ঝোপের আড়ালে নিকন এফ-এম-টু নিয়ে করমোরান্টের আশায় বসে থাকা। ভাবলাম, এই সু্যোগ। যে যে পাখি এখানে সকাল থেকে চোখে পড়ছে, সেগুলো আমার মত করে লিখে রাখি। ভবিষ্যতে হয়তো কখনো কোন গবেষকের কাজে লাগতে পারে।
এটা অনেকেই জানেন যে পূর্ব বর্ধমান জেলার বেশিরভাগ পাখি পূর্বস্থলীতে পাওয়া যায়, প্রায় ২১০ রকম। এরপর বড়শূল। ১৫০র আশেপাশে। কিন্তু বর্ধমান শহরে মাত্র ৭০-৮০ রকম পাখি দেখা যায়, যার অনেকটাই গোলাপবাগ, কৃষ্ণসায়র আর দামোদরের চরে। সাধারন মানুষ এইসব জায়গাতেই শীতকালে ভীড় করেন পাখি দেখতে। কিন্তু মহারাজের তৈরি ৩৩ একর জায়গা জুড়ে কৃষ্ণসায়র হ্রদ ও জঙ্গলের খুব কাছে আমাদের অভয়কাননেও যে বেশ কিছু রকম পাখি দেখা যায়, সেটা হয়ত অনেকেরই অজানা। সুতরাং আজ নোটবুক খুললাম, ‘অভয়কানন’।
লেখা শুরুর আগে প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে আমার এই পাখি পরিক্রমা ছ’মাসের। গত বছর মার্চ মাঝামাঝি থেকে পুজো অব্ধি। এর মাঝে যা যা পাখি দেখেছি। এটাও বলে রাখা দরকার যে বিগত শীতকালে আমি অভয়কাননের পুকুরে কোন হাঁস বা সারস জাতীয় পরিযায়ী পাখি আসতে দেখিনি। এলে চোখে পড়তই।
এবার লিখতে বসে একটু ইতস্তত করলাম, কিভাবে লিখব। আমি তো কোন ডিগ্রিধারী জুলজিস্ট বা অরনিথোলজিস্ট নই, শখের জঙ্গল-চড়ুয়া ও পাখি-দর্শক -- পাখির জেনাস স্পিসিজ কিছুই জানি না। বড়জোর পঞ্চাশ-ষাট রকম পাখি চিনি। তাও কিভাবে চিনি? পাখির গায়ের রং, লেজের বাহার, ঠোঁটের আকার, মাথা-ঝুঁটি আর পায়ের আকার, এইসব দেখে পাখি চিনি। পাখির ডাক শুনে পাখি চিনি। কিন্তু সেগুলো যদি নামানুযায়ী পরপর লিখি, বেশ কাঁচা কাজ হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং পাখির শারীরিক আকার, ব্যবহার বা গোত্র/পরিবার ধরে বর্ণানুক্রমিক নোট করি, এবং কি ধরনের পাখি। সেটা কাজে লাগলেও লাগতে পারে। আমি যে যে গোত্রের পাখি প্রায় রোজ এখানে দেখেছি, সেগুলোর বিষয়ে সবাই মোটামুটি কমবেশি জানেন। এরা হলঃ চড়াই, মাছরাঙা, বাতাসি, বক, পায়রা, কাক, কোকিল, ফিঙে, দোয়েল, মৌটুসী, কাঠঠোকরা, টিয়া, বুলবুলি, প্যাঁচা, শালিখ ও ছাতারে জাতীয় পাখি। এটাও জানিয়ে রাখি যে আমার লিখে দেওয়া আকার কিন্তু নির্ভুল নয়, মাপের একটু রকমফের থাকতেই পারে। তাহলে শুরু করা যাক।
ক) চড়াই জাতীয় (Alaudidae & Passeridae family): আকারে ১০-১৫ সেমি। মুঠোয় ধরা যায়। অনেকে বলে মোবাইল আসার পর এদের সংখ্যা খুব কমে গেছে। যদিও এই তথ্য প্রমাণসাপেক্ষ, তবে এটা ঠিক যে আজকাল শহরাঞ্চলে এদের আর প্রায় দেখাই যায় না। আমরা ভাগ্যবান যে এখানে ৩ রকম চড়াই দেখা যায়।
১) চড়াই (House Sparrow): গলার ডাক সরু, অনেকটা বাচ্চাদের মত। ‘চিরুপ চিরুপ চিরুপ চিরুপ...’। অনেকে একসঙ্গে থাকতে ভালবাসে। বাকি তথ্য [৩] এ দেওয়া আছে।
২) মাঠ চড়াই (Bengal Bush Lark): ডাক চড়াইয়ের মত। আকারেও। ডানায় ধূসরের কারুকাজ একটু বেশি।
৩) ভরত (Oriental Skylark): আকারে চড়াইয়ের থেকে একটু বড়। মাথায় ছোট ঝুঁটি। মাঠে বা ক্ষেতে-খামারে দানা খুঁটে খেতে দেখা যায়। ভাল করে শুনলে বোঝা যায় এদের ডাক সামান্য আলাদা - ‘চিরক চিরক চিরক...’।

ছবি ১: ভরত (উইকিপিডিয়া থেকে)
খ) মাছরাঙা জাতীয় (Alcedinidae family): মাপে ১৮-৩০ সেমি। মাছরাঙা বলেই এই শ্রেণীর পাখি যে শুধু মাছ খেয়ে বাঁচে, তা নয়। পোকা, ব্যাং, কাঁকড়া, শামুক, গুগলি, কেঁচো, বিছে, এসব অনেক কিছুই এরা খায়।
৪) ছোট মাছরাঙা (Common Kingfisher): ছোট পাখি। মাপে চড়াইয়ের থেকে একটু বড়। ঠোঁট কালো ও বড়। মাথা-ডানা নীল। বুক-পেট লালচে হলুদ। পুকুরপাড়ে নিচু ডালে বসে থাকে। খুব ভাল মাছ শিকারী।
৫) সাদাবুক মাছরাঙা (White Throated Kingfisher): আকারে শালিখের থেকে একটু বড়। মাথা-পেট খয়েরি, গলা-বুক সাদা। ডানা নীল। উড়ে যাবার সময় তীক্ষ্ণ ‘কিঁ কিঁ...’ আওয়াজ করতে থাকে। এর তথ্য [৩] এ দেওয়া আছে।

ছবি ২: সাদাবুক মাছরাঙা (উইকিপিডিয়া থেকে)
৬) চিতে মাছরাঙা (Pied Kingfisher): শালিখের সমান আকার। ঠোঁট কালো। সারা গায়ে ডানায় সাদার ওপর কালো ছোপ ছোপ আছে। তীক্ষ্ণ ‘চির্ক চির্ক...’ আওয়াজ। এর সঙ্গে সাদা-কালো কাঠঠোকরার তফাৎ [২] এ পাবেন।
গ) বাতাসি জাতীয় (Apodidae family): ১০-২০ সেমি দৈর্ঘ্য। দুর্বল পা কিন্তু ধারাল নখের জন্য এরা পুরোন বাড়ি বা তালগাছে খাড়াই ঝুলে থাকে। পাখিদের ভেতর এরা খুব দ্রুতগতিতে উড়তে পারে।
৭) তালবাতাসি (Asian Palm Swift): আকারে চড়াই-এর থেকেও ছোট। সরু লম্বাটে পাখি। লম্বা ডানা। অনেকটা কাস্তে বা বুমেরাং-এর মত বাঁকা। লেজ সরু হয়ে গেছে। আকাশে ওড়ার সময় টাল খেয়ে উড়তে থাকে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, লম্বাটে চামচিকে উড়ছে। উড়তে উড়তে সরু গলায় ‘ট্রি-রি-রি-রি’ ডাকতে থাকে। পুরোনো বাড়ির দেওয়ালের ফাঁকফোকড়ে বা কড়িবরগায় বা তালগাছে এদের ঝুলে থাকতে দেখা যায়। ডিসেম্বর অব্ধি অভয়কাননের আকাশে বিকেলবেলা এই শ্রেণীর পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে দেখতাম। কিন্তু যবে থেকে এই ‘ইঞ্জিনবাগানের’ বহু পুরোনো রাজার ইঞ্জিনীয়ারের অট্টালিকা ভেঙে ফেলা হয়েছে, এদের খুব কম দেখছি। আপাতত তালগাছে একজোড়া বাতাসি ঝুলে থাকতে দেখেছি। সেইজন্য এদের ‘তালবাতাসি’ হিসেবেই ধরলাম, ‘বাতাসি’ হিসেবে নয়।

ছবি ৩: তালবাতাসি (লেখকের তোলা)
ঘ) বক জাতীয় (Ardeidae family): আকৃতিতে রকমফের আছে। দেড় ফুট থেকে সাড়ে তিন ফুট অব্ধি। মাছ খায়। গোরু মোষের গা থেকে খুঁটে পোকা খায়। আবার বড় সাইজের বক সাপ-ব্যাঙ অনেক কিছুই খায়। পুকুর নদীর পাড়ে এদের ঝাঁকে ঝাঁকে দেখা যায়। এক-দেড় ফুট লম্বা পা। আওয়াজ গার্গল করার মত। পুরোটা বুঝতে পারিনি।
৮) বক (Great Egret): লম্বায় তিন ফুটের কাছে। সাদা। হলুদ ঠোঁট। পুকুরপাড়ে কয়েকবার দেখেছি।
৯) গো বক (Cattle Egret): দু ফুটের আশেপাশে। গায়ে ডানায় কমলা রংয়ের আভাষ আছে। কমলা ঠোঁট। রোজ দেখি গরু চরতে এলেই তাদের সঙ্গে এঁটুলির মত লেগে থাকে। ভোকাল কর্ড কাঁপে কিন্তু শব্দ বুঝতে পারি না।

ছবি ৪: গো-বক (লেখকের তোলা)
১০) বলাকা (Little Egret): দু ফুটের আশেপাশে। রং সাদা। কালো ঠোঁট। এদের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দারুন লাগে।
১১) কোঁচ বক (Indian Pond Heron): মাত্র দুদিন দেখেছি। বাকি তথ্য [৩] এ পাবেন।
ঙ) পায়রা/ঘুঘু জাতীয় (Columbidae family): ৩০-৪০ সেমি। শালিখ ও কাক গোষ্ঠীর ঠিক মাঝামাঝি আকারের। সাধারনত পায়রা একটু বড় হয়, আর ঘুঘু একটু ছোট। এই জাতীয় পাখির ডাক বেশ গম্ভীর। এদের দেখেছি ফেলে দেওয়া খাবার, দানাশস্য, ফল, ফলের বীজ ইত্যাদি খেতে। সাধারনত বাড়ির ওপরদিকে ঘুলঘুলিতে এরা বাসা বাঁধে।
১২) গোলা পায়রা (Rock Pigeon/Hill Pigeon): এই পাখি ও তার ডাক সবাই জানে ও চেনে। এরা অনেকে একসঙ্গে কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। এদের বিষয়ে অনেক তথ্য [৩] এ দেওয়া আছে।
১৩) হরিয়াল (Green Pigeon): আকারে পায়রার মত। সততার সঙ্গে বলি, হরিয়াল বা সবুজ পায়রা আমি অভয়কাননে দেখিনি। রাস্তার ওপাড়ে কৃষ্ণসায়রের পাশের কোয়ার্টারগুলোর ছাদে দেখেছি, দু-তিনবার। যেহেতু নিজের ক্যাম্পাস থেকে দেখেছি, তাই ধরে নিলাম এরাও অভয়কাননেই দৃশ্যমান।
১৪) ছিটে ঘুঘু (Spotted Dove): পায়রার থেকে একটু ছোট। ডানা জোড়া সাদা ছিটে দাগ আছে। গম্ভীর ডাক ‘গ্রুক গু-র-র-র-র-র-র-গ্রুক’। চৈত্র দুপুরে অনবরত শুনেছি। খুব বদমাশ পাখি। শালিক হাঁড়িচাঁচা দেখলেই তাড়া করে।

ছবি ৫: উড়ন্ত ছিটেঘুঘু (লেখকের তোলা)
১৫) কন্ঠী ঘুঘু (Collared Dove): এরা পায়রা গোষ্ঠীর সবথেকে ছোট পাখি। শালিখের থেকে সামান্য বড়। গলার পেছনে কালো কলার থাকে। গম্ভীর ডাক ‘গ্রুক গ্রু-গ্রু...’।

ছবি ৬: কন্ঠী ঘুঘু (উইকিপিডিয়া থেকে)
চ) কাক জাতীয় (Corvidae family): আকারে ৪৫-৫৫ সেমি। শালিখের প্রায় দেড়-দু গুণ। সমাজবন্ধু। সমস্ত ধরনের নোংরা খেয়ে আমাদের সমাজ পরিষ্কার রাখে।
১৬) কাক (House Crow): এদের সবাই জানে ও চেনে। এদের সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য [৩] এ দেওয়া আছে।
১৭) দাঁড়কাক (Common Raven): আকারে কাকের থেকে প্রায় ১০ সেমি বড়। ধীরে ধীরে ‘ক্র ক্র ক্র...’ ডাকে। কালো কুচকুচে। শান্ত ও চুপচাপ থাকে। এর ভাল নাম কাকেশ্বর কুচকুচে হওয়া উচিৎ ছিল।
১৮) হাঁড়িচাঁচা (Rufous Treepie): দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ সেমি। একদম চন্দনার মত। কাকের থেকে একটু ছোট কারন লেজ বড়। রুফাস মানে কালচে খয়েরী। সাধারণ কাকের যদি খয়েরী বুক-পেট-ডানা করে দেওয়া হয়, ডানায় সাদার বর্ডার, আর সাদা-কালো পালকে ঢাকা লম্বা একটা লেজ, তাহলে তৈরি হয় হাঁড়িচাঁচা। সাধারনত দুটো হাঁড়িচাঁচা একত্রে থাকলে বেশি চিৎকার করে না। কিন্তু ৫-৬ টা একসঙ্গে থাকলে কর্কশ গলায় ‘ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ-ক্যাঁ’ করে চারদিক ঝালাপালা করে দেয়। সহজেই বোঝা যায়, কেন এদের নাম হাঁড়িচাঁচা হল।

ছবি ৭: হাঁড়িচাঁচা (লেখকের তোলা)
ছ) কোকিল জাতীয় (Cuculidae family): ৩৫-৫০ সেমি। এরা প্রধানত যে কোন ধরনের পোকামাকড় খায় কিন্তু এদের প্রিয় খাদ্য হল শুঁয়োপোকা।
১৯) কোকিল (Asian Koel): আকারে কাকের মত। দেখতে একদম দাঁড়কাকের মত। শুধু চোখ লাল। পুরুষের ডাক অনেক দীর্ঘ -- ‘কু-উ কু-উ কু-উ কুহু কুহু কুহু কুহু’। মেয়েদের বুক-পেট-লেজে কালোর ওপর সাদা ডোরা থাকে। ডাক ছোট, তীক্ষ্ণ এবং একটু অন্যরকম -- ‘কিঁক-কিঁক-কিঁক-কিঁক’। শুধু সকালে বা বিকেলে নয়, কচ্চিৎ মাঝরাত্তিরেও এদের ডাক শোনা যায়। বাকি অনেক তথ্য [৩] এ দেওয়া আছে।
২০) চাতক (Pied Cuckoo): মার্চ মাসের মাঝামাঝি দুদিন বৃষ্টি হয়েছিল। সেই দুদিন আকাশে মেঘ ঘনানোর পর দেখেছিলাম এক চাতক সোনাঝুরির ডালে বসে আছে। আর কখনো দেখিনি। প্রথমে ভেবেছিলাম বুলবুলি। ভাল করে দেখে বুঝলাম এর সাইজ বুলবুলির থেকে অনেক বড়। বুক-পেট ধূসর। পায়রার মত লম্বা। ‘পিউ-পিউ’ ডাক শুনে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে ঐ পাখি চাতক।

ছবি ৮: চাতক (উইকিপিডিয়া থেকে)
২১) কুবো (Greater Coucal): দাঁড়কাকের সমান মাপের এবং একইরকম দেখতে। শুধু চোখ লাল, ডানা খয়েরী এবং লম্বা লেজ আছে যার রং অনেকটা কালচে নীল। এদের ডাক শুনিনি। দাঁড়কাক যেমন সবাইকে এড়িয়ে একধারে একা বসে থাকে, এরাও ঠিক তাই।
জ) ফিঙে জাতীয় (Dicruridae family): আকারে ২৫-৩৫ সেমি। এদের পোকাভুক পাখি নাম দেওয়া উচিৎ।
২২) ফিঙে (Black Drongo): শালিখের আকারের কালো পাখি, পেছনে লম্বা লেজ যেটা শেষে গিয়ে মাছের লেজের মত দুভাগ হয়ে গেছে। এদের মাঝে মাঝেই ইলেকট্রিক বা কেব্ল লাইনে বসে লেজ নাড়তে দেখা যায়। গলার স্বর মোটেও মধুর নয়। সারাক্ষণ পোকা খায়। এদের বিষয়ে অনেক তথ্য [৩] এ পাবেন। নীলফিঙে দেখিনি।

ছবি ৯: ফিঙে (লেখকের তোলা)
ঝ) গায়ক জাতীয় (Muscicapidae family): এই শ্রেণীর সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। যারা ভাল গান গায়। চুটকি, নীল কটকটিয়া, দোয়েল, পাপিয়া অনেকেই।
২৩) দোয়েল (Oriental Magpie Robin): শালিখের থেকে ইঞ্চি দুয়েক ছোট। রবিন ব্লু বলতে যা বোঝায়, গায়ের রং ঠিক তাই। কিন্তু দূর থেকে সেটা কালো বলেই মনে হয়। বুক-পেট সাদা, ডানায় সাদা দাগ। গান গাইবার সময় লেজ উঁচিয়ে থাকে। রোজ দেখি বিকেল ৪টে নাগাত একটা দোয়েল এসে শিমূল গাছের সবচেয়ে উঁচু সরু ডালে বসে, প্রায় আধঘন্টা গান শোনায়, আবার ফুরুৎ উড়ে যায়। রোজ আলাদা গান। আমি ওর ৮-১০-১২ নোট গানের ওপর নিজের কথা বসাই। যেমন ‘ব্যাটা চোর, কোথা যাস, আয় আয় আয়’ বা ‘তিন দিন তোর দেখা নেই, কোথায় ছিলি তুই?’ বা ‘ওকে লন্ডন, রেডি টু ইট, নিউ নিউ’। এপ্রিলের শুরু থেকে রোজ মাঝরাত্রে, প্রায় ২টো-৩টে নাগাত, কোন এক দোয়েল ছোট নোটের ডাক দিয়ে চমকে দেয়। আমি বুঝতেও পারিনি ওটা দোয়েলের ডাক। রেকর্ড করি। পরে ই-বার্ড এ গিয়ে অন্তত ২৫-৩০ রকম দোয়েলের গান শুনে দেখি একটার সঙ্গে হুবহু। এদের সঙ্গে অনেকে খঞ্জনকে গুলিয়ে ফেলেন। দোয়েলের সঙ্গে খঞ্জনের তফাৎ কিন্তু মূলত মাথায় আর লেজের চলনে। তাছাড়া, দোয়েলের মত একটানা ৩০-৪০ মিনিট আর কোন পাখি গাইতে পারে কি? বাকি অনেক তথ্য [৩] এ দেওয়া আছে।
এই ফ্যামিলির আর কোন পাখি, যেমন পাপিয়া বা শ্যামা, চারদিক দেখেও আমার নজরে আসেনি। তবে দোয়েলের কথা যখন উঠলই, তখন অন্য শ্রেণীর আরো দু-ধরনের গায়ক পাখির কথা এখানেই লিখে নেওয়া যাক।

ছবি ১০: দোয়েল (উইকিপিডিয়া থেকে)
২৪) খঞ্জন (White Wagtail): এরা Motacillidae family র। দোয়েলের মাপের পাখি। ছোট ৩-৪ নোটে ভাল গান গায়। মাথায় বেশ খানিকটা সাদার পোঁচ আছে। আর গান গাইবার সময় এদের লেজ মাঝে মাঝেই ওঠানামা করে।

ছবি ১১: খঞ্জন (hbw.com থেকে)
২৫) ফটিক-জল (Common Iora): এরা Aegithinidae family র। মাপে ভরতপাখির সমান। দেখতে দারুন। মাথার ওপর দিক কালো। ঠোঁটের নিচ থেকে গলা বুক পেট জলপাই হলুদ, ডানায় কালোর ওপর সাদা স্ট্রাইপ, লেজ কালো। ছোট ৩-৪ নোটে ভাল গান গায়। হঠাৎ এদের গান শুনলে দোয়েল গাইছে মনে হতে পারে।
ঞ) মধুপেয়ী জাতীয় (Nectariniidae family): এরা আকারে খুব ছোট। ৮-১০, বড়জোর ১২ সেমি। দেখতে সুন্দর, রঙিন। সরু বাঁকা ছূঁচের মত ঠোঁট। ঠোঁটের ভেতর লুকিয়ে থাকা সরু সূতোর মত জিভ বাইরে এসে ফুলের ভেতর মধুর খোঁজে ঢোকে। ফুলের মধু ও ছোট কীটপতঙ্গ খায়। মানুষকে এড়িয়ে চলে।
২৬) মৌটুসী (Purple-rumped Sunbird): বেগুনি মাথা হলুদ বুক মৌটুসী কোন না কোন লাল ফুলের বাগানে আমরা সবাই কখনো দেখেছি। আকারে এরা আর দুর্গা টুনটুনি একদম সমান। দুপুরবেলা এদের গায়ে যেভাবে সূর্যের আলো ঠিকরে বেরোয়, মনে হয় সেখান থেকেই সানবার্ড কথাটার উৎপত্তি।
২৭) দুর্গা টুনটুনি (Purple Sunbird): রক্তকরবী আর জবা গাছে রোজ দুপুরের নির্জনতায় বাঁকা ঠোঁট ডুবিয়ে মধু খুঁজতে দেখেছি। এত সুন্দর বেগুনি রং, একবার দেখলে আর চোখ ফেরানো যায় না। এটাও বলে রাখি যে বেগুনি রং পুরুষ আর ধূসর হলদেটে মেয়ে, দু-রকম লিঙ্গের পাখিই এখানে দেখেছি। এদের বিশদ তথ্য [৩] এ পাবেন।

ছবি ১২: দুর্গা টুনটুনি (উইকিপিডিয়া থেকে)
পর্ব ২
ট) কাঠঠোকরা জাতীয় (Picidae family): আকারে ২৫-৩৫ সেমি। শালিখের থেকে একটু বড়। মাথায় ঝুঁটি, শক্ত লম্বা ঠোঁট এবং শিকারী পাখির মত পায়ের লম্বা নখ দেখা যায়। মরে যাওয়া গাছের ছালে ঠোকড় মারতে এদের বেশি উৎসাহ দেখেছি। হয়ত সেখানে বেশি কীট পাওয়া যায়। এদের ডাক শুনিনি।
২৮) সাদা-কালো কাঠঠোকরা (Stripe Breasted Woodpecker): আকারে শালিখের মত। ডানায় সাদার ওপর কালো ছোপ ছোপ আছে। পুরুষের মাথায় লাল ঝুঁটি। এদের রোজ দেখি শিরীষ আর সোনাঝুরিতে এসে ঠোকরাতে।
২৯) সোনালি কাঠঠোকরা (Lesser Goldenbeck): শালিখের থেকে একটু বড়। সবসময় জোড়ায় থাকে। মাথায় লাল ঝুঁটি। বুক পেট সোনালি। বুকে চড়াই পাখির মত ধূসর দাগ আছে। প্রায় প্রতিদিন দেখি। একবার আমার বাথরুমের ঘূণধরা জানলার বাইরে দুজন দুদিক থেকে ঠোকরাতে শুরু করেছিল, কোনমতে তাড়িয়েছি।

ছবি ১৩: সোনালি কাঠঠোকরা (লেখকের তোলা)
ঠ) টিয়া জাতীয় (Psittacidae family): আকারে ৪০-৫০ সেমি। শালিখের থেকে সামান্য বড়। পেছনে লম্বা লেজ থাকার জন্য দৈর্ঘ্য একটু বড় মনে হয়। গাছের উঁচু ডালে থাকে। এরা দেখতে খুব সুন্দর হলেও বেশ বদমাশ পাখি। যেখানে থাকে সেখানে দানাশস্যর ক্ষেত থাকলে সেগুলো খেয়ে শেষ করে দেয়। এরা যে গাছে থাকে, তার কাছাকাছি শালিখ দেখলেই তাড়া করে ভাগায়। এরা সুন্দর হলেও এদের ছানারা কিন্তু সুন্দর হয় না।
৩০) চন্দনা (Alexandrine Parakeet): লম্বায় অন্যদের থেকে বড়, প্রায় ৫০ সেমি। রং একদম হালকা সবুজ। পুরুষদের গলায় কালো কলার থাকে। ঠোঁট লাল। ডানার ওপর লাল দাগ। বিরক্তিকর তীক্ষ্ণ ‘ক্রিঁক ক্রিঁক ক্রিঁক...’ ডাকে, ডেকেই চলে। নিস্তব্ধ দুপুরে কান ঝালাপালা করে দেয়।

ছবি ১৪: একসাথে চন্দনা ও দোয়েল (লেখকের তোলা)
৩১) মদনা টিয়া (Red Breasted Parakeet): ৪০ সেমি লম্বা। বুক লালচে। ঠোঁটের নিচ থেকে গলার মাঝামাঝি গোঁফের মত মোটা কালো দাগ আছে। তীক্ষ্ণ কিন্তু ভারী গলা ‘ক্যাঁ ক্যাঁ ক্যাঁ...’। কম ডাকে, থেমে থেমে ডাকে।

ছবি ১৫: মদনা টিয়া (pinterest.com থেকে)
৩২) টিয়া (Rose Ringed Parakeet): ৪০ সেমি। কলাপাতা রং। চন্দনার রংয়ের থেকে গাঢ়। তীক্ষ্ণ ডাক, চন্দনার মত। পুরুষদের গলায় গোলাপি কলার থাকে। বাকি তথ্য [৩] এ পাবেন।
ড) বুলবুলি জাতীয় (Pycnonotidae family): মাপে ১৫-২৫ সেমি। মূলত ফুল ফল বীজ খেয়ে থাকে। পোকাও খায়। ভারতে শুনেছি অনেক রকমের বুলবুলি দেখা যায়। কিন্তু আমার নজরে এসেছে মাত্র এক রকম।
৩৩) বুলবুলি (Red-vented Bulbul): রোজ সন্ধের মুখে একজোড়া বুলবুলি দেখেছি টানা একমাস। কিন্তু বুঝতে পারিনি আলো কম থাকার জন্য। তারপর বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে নিশ্চিত হলাম। আকারে ভরতপাখির থেকে একটু বড়, শালিখের থেকে ছোট। মাথা-ঝুঁটি কালো। বুক-পেট ধূসর খয়েরী। লেজের গোড়ায় লাল দাগ। শিমূলের কচি পাতা খেতে দেখেছি। ‘প্যাঁপ...প্যাঁপ’ ডাকে, মাঝে মিহি কয়েকটা নোট থাকে। খঞ্জনের মত লেজ নাড়ে।

ছবি ১৬: বুলবুলি (লেখকের তোলা)
ঢ) প্যাঁচা জাতীয় (Strigidae family): এরা মূলত রাতের শিকারী পাখি। অন্ধকার নামার পর শিকার ধরতে বেরোয়। আকার অনেক রকমের হয়। বড় গাছের কোটরে বা পাথরের খাঁজে থাকে।
৩৪) নিম প্যাঁচা (Indian Scops Owl): শালিখের মাপের পাখি। মাঝে মাঝেই সন্ধের মুখে শিরিষের ডালে এসে চুপচাপ বসে। এদের রাতচেরা থামা থামা গম্ভীর ডাক ‘চুপ চুপ চুপ চুপ...’ শুনলে গা ছমছম করে।
৩৫) লক্ষ্মী প্যাঁচা (Barn Owl): পায়রার আকার। মুখ গা লেজ সাদা। ডানায় সোনালি বা খয়েরি ছাপ আছে। এখানে কখনো দেখিনি কিন্তু প্রায় রোজ রাতে ভারী গলার লম্বা ডাক ‘ক্যাঁ-য়া-য়া-য়া-য়া-চ ক্যাঁ-য়া-য়া-য়া-য়া-চ...’ শুনে বুঝেছি এরা এখানে থাকে।
প্যাঁচাদের বিষয়ে বলতে গিয়ে আরেক শ্রেণীর রাতের শিকারী পাখির কথাও এখানে বলে নিই। রাতচরা জাতীয় (Caprimulgidae family)। মাটির কাছাকাছি গাছের নিচু ডালে বসে থাকে বা বাসা বানায়।
৩৬) রাতচরা (Indian Nightjar): আকারে শালিখের মত। একেও দেখিনি কিন্তু প্রায় রোজ সন্ধে বা রাতে বা মাঝরাতে এর ফু-র-র-র হুইসিলের মত ডাক ‘চুক চুক চুক চুক চু-ক-র-র-র-র-র-র-র...’ শুনেছি।
ণ) শালিখ জাতীয় (Sturnidae family): আকারে ২২-৩০ সেমি। এরা পোকামাকড় থেকে শুরু করে গাছের ফল, সবকিছু খায়। টিয়াপাখির মত এরাও গাছের ফোকড়ে থাকতেই ভালবাসে। নীল রঙের ডিম পাড়ে।
৩৭) শালিখ (Common Myna): তীক্ষ্ণ ডাক ‘ক্রিঁ ক্রিঁ ক্রিঁচ ক্রিঁচ...’ কিন্তু চন্দনার মত তত জোরে নয়। বাকি তথ্য [৩] এ দেওয়া আছে।
৩৮) গাং শালিখ (Bank Myna): আকারে শালিখের সমান। চোখ ও ঠোঁট শালিখের মত হলুদ নয়, কমলা।
৩৯) ঝুঁটি শালিখ (Jungle Myna): মাত্র একবার দেখেছি। আকারে শালিখের সমান। ঠোঁট শালিখের মত হলুদ, কিন্তু চোখের আশপাশে কোন হলুদ নেই, পুরো মাথা কালচে। ঠোঁটের পেছনে ছোট ঝুঁটি আছে। তাকালে মনে হয়, ছাতারের মতই বিরক্ত হয়ে দেখছে।

ছবি ১৭: ঝুঁটি শালিখ (উইকিপিডিয়া থেকে)
৪০) গো শালিখ (Asian Pied Starling): আকারে শালিখের সমান। তীক্ষ্ণ ডাক ‘টুইক্রিঁচ টুইক্রিঁচ টুইক্রিঁচ...’। জোড়ায় থাকে। গায়ের রং প্রায় খঞ্জনের মত কিন্তু খঞ্জনের থেকে একে আলাদা করা যায় দুভাবে। এক, গো-শালিখের ঠোঁটের রং কমলা। দুই, লেজ ছোট এবং সেটা খঞ্জনের মত সারাক্ষণ নড়তে থাকে না।

ছবি ১৮: গো শালিখ (birding.in থেকে)
৪১) পাহাড়ি ময়না (Common Hill Myna): শালিখের ভেতর সবথেকে সুন্দর প্রজাতি। ঠোঁট কমলা। ঠোঁটের পেছন থেকে ঘাড় জুড়ে হলুদ রঙের বেড় আছে। এর ডাক অসাধারন। অনেকটা গীটারের ১ আর ৬ কর্ডে ‘ক্রিক...চিউব চিউব’ বাজানোর মত। যে কোন ডাক নকল করতে পারে। এদের ডাকের ভিডিওটা দেখুন।
ভিডিও ১: শিমূল গাছে পাহাড়ি ময়নার ডাক (লেখকের তোলা)
ত) ছাতারে জাতীয় (Timalidae family): ২৫-৩০ সেমি। মাটিতে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট ও পোকা খেতে পছন্দ করে।
৪২) ছাতারে (Jungle Babbler): এদের সাত-ভাই বলেও ডাকা হয় কারন এরা অনেকে একসঙ্গে থাকে। আকারে পাক্কা শালিখের সমান, শুধু একটু মোটাসোটা। গায়ের রং পুরো ধূসর। মাটির আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে, মাটিতে ড্রেনে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট খাবার বা পোকামাকড় খায়। মাঝে মাঝে উড়ে গিয়ে গাছের নিচু ডালে বসে, তারপর পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরের দিকে ওঠে। এরা তাকালে মনে হয়, খুব বিরক্ত হয়ে আছে। স্বর বেশ কর্কশ ‘কিঁ-কিঁ-কিঁ-কিঁ...’। সারাক্ষণ একসাথে ডেকেই চলে। এদের এই কর্কশ স্বর আর বিরক্ত হয়ে তাকানো থেকেই কি ‘ছাতারে মুখ’ কথার উৎপত্তি?

ছবি ১৯: ছাতারে (লেখকের তোলা)
আমার দুর্ভাগ্য যে ওপরে যে যে পাখিশ্রেণীর কথা বললাম, তার বাইরে আমি এখানে এখনো অব্ধি বাবুই জাতীয়, ধনেশ-সারস-হাঁস জাতীয়, মুনিয়া জাতীয়, ফুটকি-চুটকি-দামা জাতীয়, আবাবিল জাতীয় বা বাজ-ঈগল-শকুন জাতীয় কোন পাখি দেখিনি। শুধু (৪৩) চিল (Black Kite) দেখেছি (এর সম্বন্ধে [৩] এ দেওয়া আছে)। এটা আমার অক্ষমতা যে এই সময়ে বা এর আগে-পরে আর কোন সাধারন শ্রেণীর পাখি বুঝতে পারি নি। হয়তো আমার অজান্তেই তারা উড়ে গেছে। এবং আক্ষেপ রয়ে গেল যে এতদিনে একবারো দুধরাজ দেখতে পেলাম না।
এবার আসব একটু অন্যরকম পাখির কথায়, যেগুলো কালেভদ্রে আমার চোখে পড়েছে। মনে হয়, এরা বেশ লাজুক পাখি। মানুষের থেকে দূরে থাকে। এর ভেতর প্রথম শ্রেণী হল এক ধরনের হলুদ পাখিঃ বউ কথা কও বা ইষ্টি-কুটুম।
থ) বউ কথা কও (Oriolidae family): এই ধরনের পাখির গায়ের রং পাকা আমের মত হলুদ। শালিখের আকার। এপ্রিল থেকে জুনের ভেতর বাসা বোনে, ডিম পাড়ে। পোকা আর ফলমূল খায়।
৪৪) বেনেবউ (Black Hooded Oriole): মাথা ও গলা কালো। ডানার পেছনদিক কালো। বাকিটা হলুদ। চোখ ও ঠোঁট লাল। কখনোসখনো দুপুরে একবার কৃষ্ণসায়র থেকে অভয়কাননে আসতে ও ফিরে যেতে দেখেছি। মনে হয় কৃষ্ণসায়রে এর বাসা আছে। এর ডাক শুনলে মনে হবে ‘পিকু-কুহু পিকু-কুহু’।

ছবি ২০: বেনেবউ (উইকিপিডিয়া থেকে)
৪৫) সোনাবউ (Indian Golden Oriole): মাত্র একবার দেখেছি। ডানার ধারে কালো। চোখের দুপাশে মোটা কাজলের মত কালো। বাকিটা পুরো হলুদ। ঠোঁট লাল। একে ডাকতে শুনিনি।
দ্বিতীয় শ্রেণী, আবারো কিছু রঙিন পাখি –- নীল সবুজ হলুদ লাল আকাশি খয়েরি সব মিশে আছে –- যেগুলো অর্ডার বা ফ্যামিলি হিসেবে ঠিক ভাগ করা যাবে না। আমি বরং এভাবে লিখিঃ
দ) নীল-সবুজ রঙিন পাখি (Megalaimidae, Coraciidae and Meropidae family):
৪৬) বসন্তবৌরি (Brown Headed Barbet): বসন্তকালে শালিখের থেকে একটু বড় মাপের খয়েরি-মাথা লাল-ঠোঁট সবুজ পাখি বাগানে তো আসবেই। সেটাই বসন্তবৌরি। ডাক শুনে মনে হবে যেন বলছে ‘পুঁট্রু পুঁট্রু পুঁট্রু যাও, পুঁট্রু...’। ছোট ফল খেতে ভালবাসে। তবে এরা খুব লাজুক। অন্য পাখিদের সঙ্গে এদের একফ্রেমে দেখা যায় না।

ছবি ২১: বসন্তবৌরি (ebird.org থেকে)
৪৭) নীলকন্ঠ (Indian Roller): বেশ কয়েকবার দেখেছি। শালিখের আকারের পাখি। ডানায় এত সুন্দর গভীর নীল ও আকাশির সমাহার অন্য কোন পাখির আছে কিনা আমার জানা নেই। একে উড়তে দেখা এক দারুন অনুভূতি।

ছবি ২২: নীলকন্ঠ (উইকিপিডিয়া থেকে)
৪৮) বাঁশপাতি (Bee-eater): পুজোর সময় বিকেলের দিকে দেখেছি একজোড়া বাঁশপাতি গায়ে গা লাগিয়ে সোনাঝুরির ডালে বসে আছে। আকারে বুলবুলির থেকে একটু ছোট, ১৮-২০ সেমি হবে। গা অলিভ সবুজ, সরু কালো ঠোঁট, লেজের নিচে দিয়ে একটা সরু পালক আরো একটু লম্বা হয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিচিরমিচির ডাক।
পরেরটাও ভাগটাও একটু গোলমেলে। এরা সবাই আলাদা পরিবারের। একটাই মিল, বছরের বিভিন্ন সময়ে এদের জল কাদার আশেপাশে দেখা যায়।
ধ) জলাশ্রয়ী পাখি (Water-body Dependent Birds):
৪৯) পানকৌড়ি (Little Cormorant): ফেব্রুয়ারী ও মার্চের শুরুতে পুকুরপাড়ে রোজ দেখেছি। দৈর্ঘ্য দেড় ফুটের আশেপাশে। কালো কুচকুচে। পুকুরের একদিকে ডুব মেরে বেশ কিছুক্ষণ পর অন্যদিকে গিয়ে ওঠে।

ছবি ২৩: পানকৌড়ি (লেখকের তোলা)
৫০) ডাহুক (White Breasted Waterhen): মাঝে মাঝে দেখেছি, জানলার পাশে লুকিয়ে। মানুষ দেখলেই এরা পালায়। পায়রা আকারের পাখি। ধূসর কালো পিঠ। গলা বুক পেট সাদা। ঠোঁটের ওপর লাল ছোপ আছে। নিস্তব্ধ দুপুরে এদের ডাক ‘হুক হুক হুক হুক...’ একটু কান পাতলেই শোনা যায়।

ছবি ২৪: ডাহুক (লেখকের তোলা)
৫১) কাদাখোঁচা (Common Snipe): ধরা যাক একটা চড়াই (Bengal Bush Lark)। একে যদি আকারে বড় করে ঘুঘুর মত করা যায়, শক্ত দুটো বাঁকা পা দেওয়া যায় আর মুখের সামনে একটা ল-ম-বা ৪ ইঞ্চি ঠোঁট দেওয়া যায়, তাহলে যে পাখি আমরা দেখতে পাব, সেটাই কাদাখোঁচা। এরা পুকুরপাড়ে কাদা বা ঝোপের ভেতর থাকে।

ছবি ২৫: কাদাখোঁচা (উইকিপিডিয়া থেকে)
আর একটা পাখির ডাক আমি এপ্রিল মাসে বেশ ক’বার দুপুরবেলা শুনেছি। সেটা হল (৫২) হুপো (Common Hoopoe) বা মোহনচূড়া। ঐ ‘হু-হু-হু হু-হু-হু হু-হু-হু...’ শুনেই বারবার ছাদে দৌড়ে গেছি। কোথাও দেখতে পাইনি। রোদ্দুরের জন্য বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও পারিনি। কিন্তু আমার বিশ্বাস এখানে হুপো আছে।

ছবি ২৬: হুপো (উইকিপিডিয়া থেকে)
আমার মোবাইলে এই ৫২ রকম পাখির অন্তত ৪০ টার ছবি আছে। মুশকিল হল, মোবাইলের ফটো এত আবছা যে একটু বড় করলে কিছুই প্রায় বোঝা যায় না। ফলে পাঠকের সুবিধের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাখির ফটো আমাকে ইন্টারনেট থেকে নিতে হল বোঝার সুবিধের জন্য এবং কোথা থেকে নিলাম সেটা কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করলাম। তবে [৩] নং তথ্যসূত্রে যে যে পাখির ছবি দেওয়া আছে, সেগুলো আর এখানে অনাবশ্যকভাবে দেওয়া হল না। এখানে আলোচিত ৫২টা পাখির সুন্দর ছবি আপনি ইন্টারনেটে পেয়ে যাবেন। আর পাখি নিয়ে যদি গভীরে জানার ইচ্ছে থাকে, তাহলে [২] নং তথ্যসূত্র বা সেলিম আলির বই পড়ুন। পড়ে মজা পাবেন। পাখি ভালবাসতে ইচ্ছে করবে।
পাখিদের আমি সবসময় খোলা আকাশেই দেখতে ভালবাসি। সন্ধেবেলা কোকিলের মন উদাস করা ডাক অথবা ছাতারের বিরক্ত চোখে তাকানো অথবা একজোড়া হাঁড়িচাঁচার সাদা-কালো লম্বা লেজ মেলে ডালে উড়ে গিয়ে বসা অথবা দোয়েলের একটানা ৩০ মিনিট গান শোনানো বা কাঠফাটা দুপুরে মৌটুসির জবাফুলে ঠোঁট ঢুকিয়ে মধু টানা বা সন্ধের মুখে চড়াই-শালিখের কিচিরমিচিরের মাঝেই শিরিষের ডালে নিমপ্যাঁচার চুপচাপ বসা, এগুলো খোলা আকাশের নিচেই পাখিরা করতে ভালবাসে। খাঁচার মধ্যে নয়। তবুও কেন জানি না এক শ্রেণীর মানুষ পাখিদের খাঁচায় পুরে বিক্রি করে আনন্দ পায় এবং আরেক শ্রেণীর মানুষ সেই পাখি কিনে খাঁচায় পুষতে ভালবাসে। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। বাগানের ছোট ছোট কিচিরমিচির করা পাখিগুলো, প্রথম বছরে যদি মারা না যায় বা শিকারীর হাতে আটক না হয়, বড়জোর ৩ থেকে ৫ বছর বাঁচে। এই ছোট্ট সময়ের মাঝে ওরা বরং প্রকৃতিতেই উড়ে বেড়াক। এবং পাঠকের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে-ঝোপে-ঝিলের ধারে যেখানেই যান, ছোট বা মাঝারি সাইজের পাখির সামনে ওদের বাসার ছবি তুলবেন না। ওতে বাবা-পাখি মা-পাখি ভয় পেয়ে বাসা ছেড়ে চলে যায়, ফলে বাসায় বাচ্চা থাকলে তারা না খেয়ে মারা যায় বা চিল-সাপ-বেড়ালের খাদ্যে পরিনত হয়। কোন আজেবাজে খাবার বা ফাস্ট ফুড পাখিদের দিকে ছুঁড়ে দেবেন না। পাখিরা সাধারনত পোকামাকড়, সরীসৃপ, ফল, ফুল, ফুলের মধু, কচি পাতা, দানাশস্য ইত্যাদি খেয়ে বাঁচে। বিভিন্ন পাখির খাদ্যাভ্যাস বিভিন্ন হয়। আমাদের খাবার ওদের শরীরে সহ্য না হবার সম্ভাবনাই বেশি (কাক, শকুন ছাড়া)। সাধারণত, বসন্তকাল হল পাখিদের বাসা বাঁধা, প্রজনন ও ডিম পাড়ার সময়। আমাদের উচিৎ এই সময় ওদের কাছাকাছি না যাওয়া ও কোন রকম বিরক্ত না করা। পশু-পাখি-গাছ আছে বলেই কিন্তু পৃথিবী এত সুন্দর লাগে। শীতকালে অন্তত ১৫০ রকম পরিযায়ী পাখি ভারতে আসে বলেই শীতে নদীর ধারে অসংখ্য কিচিরমিচিরের মাঝে আমাদের পিকনিক জমে ওঠে।
মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য আজ ভারত থেকে অন্তত চার রকমের শকুন, একরকম বটের ও একরকম হট্টিটি লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে। এমনকি গোলাপি মাথা হাঁসও। বাকি পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা এখন আমাদেরই দায়িত্ব।
তথ্যসূত্রঃ
[১] জগদানন্দ রায়, বাংলার পাখী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, কলকাতা, ১৯৩২.
[২] Bikram Grewal et. al., A Pictorial Field Guide to Birds of India, Om Books, Noida, 2016.
[৩] Common Indian City Birds (Online: www.kolkatabirds.com).
[৪] List of endangered animals in India – Wikipedia (online).