রাজ-সমাজ-অর্থ + নীতি
ভাবনায় অনলাইন শিক্ষা
ভাস্করজ্যোতি দাস

সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাসে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষত চিহ্ন। জ্বালামুখীর লাভা থেকে শুরু করে করোনা মহামারীর থাবা, সবকিছুকেই মানিয়ে নিয়েছে এ পৃথিবী। মানুষ প্রয়োজনে পাল্টে ফেলেছ নিজেকে, নিজের জীবন শৈলীকে। মানুষের এই 'চলো পাল্টাই' মানসিকতাই মানুষকে এ গ্রহ থেকে নিশ্চিহ্ন হতে দেয়নি।
অবশ্য শিক্ষা ক্ষেত্রের দিকে তাকালে আমরা ততটা পাল্টানো রূপ দেখতে পাই না। গুরু গৃহ থেকে আধুনিক স্কুলের পরিভাষা ও পরিকাঠামো মোটামুটি প্রায় একই। করোনার থাবায় বা ঝটকায় শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। এই পরিবর্তন কাঙ্ক্ষিত ছিলো কি না সে অবশ্য বিতর্কিত বিষয়। তবে সব নতুন ধারণাই যে সব দিক দিয়ে ভালো হবে তা তো নয়। যারা ভারতবর্ষের সমাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান জানেন, তাঁরা বুঝতে পারেন সমস্যার শেকড় কোথায়। স্কুল বন্ধ থাকায় অনলাইন ক্লাস নেওয়ার যে পদ্ধতি তা সবার জন্য না কি একটা প্রিভেলেইজড সেকশনেল জন্য তা যাচাই করা উচিত ছিল। বুদ্ধিমানরা বলবেন, এছাড়া বিকল্প নেই। কথা সত্যি, অনস্বীকার্য। তবে এই যে বিকল্প না থাকা এ-ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। গ্রামে মাস্টার মশাই বা দিদমণিদের জিজ্ঞেস করে দেখুন না, তাঁরা অনলাইনে কতটা ক্লাস নিচ্ছেন। আর যদি নেন সেখানে অংশগ্রহণ করছেন মোট কত শতাংশ পড়ুয়া? আমি হলফ করে বলতে পারি আপনার মন যদি সংবেদনশীল হয় আপনি আঘাত পাবেন, কষ্ট হবে আপনার। বেশীরভাগ শিশুদের বঞ্চিত করে যে পদ্ধতিতে আমরা এগিয়ে গেছি তা শিশুর মৌলিক অধিকার হরণ নয়তো কি। পুরো বিষয়টি 'নেই মামা থেকে কানা মামা ভালো' রকমের। কিন্তু রাষ্ট্র এরকম হালকা দুলকি চালে চললে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবার ভবিষ্যত।
যারা শিশুদের মনস্তত্ত্ব জানেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় যারা বঞ্চিত নয় মানে প্রিভেলেইজড সেকশন, তারা যেভাবে মোবাইল ব্যবহারের লাগামছাড়া অনুমতি পেয়েছেন তাতে তাদের ভবিষ্যৎও ধ্বংস হচ্ছে, তবে একটু বাঁকা পথে এই আরকি।
যারা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন অর্থাৎ আমাদের ডাক্তার বাবুরা, তাদের কাছ থেকে জেনে নিন একটা বছর পাঁচ এর শিশু যখন ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকে মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনে তখন তাদার চোখে কতটুকু চাপ পড়ে। মাথা ঝিমঝিম করে কি না??
সোজা কথায় বঞ্চিতরা একেবারেই বঞ্চিত হচ্ছেন। আর যারা পাচ্ছেন অনলাইনে এডুকেশন তারাও খুব একটা লাভবান হচ্ছেন না।
অনলাইনে তোতা পাখির তথ্য মুখস্থ করানো যেতে পারে কিন্তু মানুষ হতে হলে স্কুলে আসতেই হবে। দিদমণিদের সামনে পড়া দিতে হবে, ক্লাসে খুনসুটি করতে হবে, ফুটবল খেলতে হবে, টিফিন ভাগ করে খেতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির সাহায্য তো নিতেই হবে তবে মাথায় রাখতে হবে দিনের শেষে আমরা হতে চাই সহৃদয়বান মানুষ। তথ্য বোঝাই রোবট নয়।
দোষ করোনা মহামারীর, তবে আমাদেরও খুব একটা কম নয়। আমাদের রাজনৈতিক বীক্ষা, রাষ্ট্র যন্ত্র এবং আমাদের দায়িত্ববোধ সব যে ভীষণ নড়বড়ে। আমারও।