রাজ-সমাজ-অর্থ + নীতি
নেতাজীর গণতান্ত্রিক চিন্তার অপপ্রচার ও কিছু কথা
রাহুল রায়, ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক
২২ জানুয়ারি ২০২১
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে বারবারই গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হওয়ার অভিযোগ ওঠে । গত কয়েক বছরে শাসনাধিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ অত্যন্ত সাধারণ হয়ে উঠেছে । সরকার সমর্থকরা এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলে থাকেন যে, এই দেশের মঙ্গলের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে অনুশাসনের বেশী প্রয়োজন । দেশ ও জাতির স্বার্থকে সর্বাগ্রে তুলে ধরতে হবে , ব্যক্তি স্বাধীনতা সেখানে বাতুলতা মাত্র । নিজেদের কথার সমর্থনে এরা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ২০ বছরের স্বৈরতন্ত্রের পরিকল্পনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে থাকেন । নেতাজীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সময় মতো হয় নি বলেই দেশের এই অবস্থা বলে তাঁরা আত্মপক্ষে যুক্তি দেন । অথচ এই নেতাজী সুভাষই বলেছিলেন, “ আমার চাই, “The Right to make blunders” , ভুল করবার অধিকার” । তিনি আরো বলেছেন, "জন্মিবামাত্র আমরা যে কাতরকণ্ঠে ক্রন্দন করিয়া উঠি সে ক্রন্দন শুধু পার্থিব বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জানাইবার জন্য । শৈশবে ক্রন্দনই আমাদের একমাত্র বল থাকে। কিন্তু যৌবনের দ্বারদেশে উপনীত হইলে বাহু ও বুদ্ধি আমাদের সহায় হয় ।” পরাধীন দেশে যে মানুষটি সারাজীবন প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিয়ে গেছেন সে মানুষই কিনা স্বাধীন দেশে নাগরিক অধিকার গুঁটিয়ে স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়াবেন, একথা কোনো ভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয় । কিন্তু এটাও ভুল নয় যে নেতাজী সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন স্বাধীন দেশে অন্ততঃ কুড়ি বছর ‘কল্যাণকামী স্বৈরতন্ত্র’ কায়েমের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন । এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায় তাহলে কি নেতাজীর মত জার্মানীর হিটলার, ইটালীর মুসোলিনী জাপানের তেজোর মতো স্বৈরশাসকদের সঙ্গে থেকে পরিবর্তিত হয়েছিল ? তাহলে কি নেতাজী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে নাগরিক অধিকারের ওপরে জাতীয়তাবাদের আদর্শকে স্থান দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন ? নাকি নেতাজী নিজেকে স্বাধীন ভারতের সর্বময় কর্তা হিসাবে দেখতে শুরু করেছিলেন ?
প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় সময়ের ব্যবধানে নেতাজীর দৃষ্টিভঙ্গি বদল হয় নি, তিনি সময়ের কাজ সময়ে করার পক্ষে ছিলেন । একটি শিশুর ভবিষ্যৎ বলিষ্ঠ করে তোলার জন্য তাকে যেমন শৈশবে অনুশাসন শেখানো উচিত, তেমনি অনুশাসনের নামে যৌবনকে চার দেওয়ালের মধ্যেও আবদ্ধ রাখা অনুচিত । তিনি ভালো করেই অনুধাবন করেছিলেন যে দুই শতকেরও বেশি সময় ধরে বিদেশী শাসনে আবদ্ধ থাকা , জাতি-ধর্ম, বর্ণের নামে শতধায় বিভক্ত , অশিক্ষা-দারিদ্রে আকণ্ঠ নিমজ্জিত একটি দেশের মানুষের মধ্যে আর যাই হোক গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষের আশা করা যায় না । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে মানুষের চেতনার ওপর । সেক্ষেত্রে জনগণকে সর্বাগ্রে শিক্ষিত হতে হবে , নিজেদের অধিকার , দায়িত্ববোধ নিয়ে ওয়াকিবহাল হতে হবে । জনসচেতনতা ভিন্ন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অন্তঃসারশূন্য । নেতাজী স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্রের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতেই কল্যাণকামী স্বৈরতন্ত্রের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন । আজকের মতো নাগরিক অধিকারের কণ্ঠরোধ করার কোনো অভিপ্রায় তাঁর কোনো কালেই ছিল না । নাগরিক অধিকার নিয়ে নেতাজীর চিন্তা আমরা পাই ১৯২৮ সনে পুনা শহরে দেওয়া বক্তৃতায়। তিনি সেখানে বলেছিলেন , “ The Constitution will be preferred by a ‘Declaration of rights’ which will guarantee the elementary rights of citizenship. Without a declaration of rights the constitution is not worth the paper it is written in" । নেতাজী কোনো কালেই ক্ষমতালোভী ছিলেন না । আপোষহীন, জেদি মানুষটার জীবনে একটাই লক্ষ্য ছিল , জন্মভূমির পূর্ণ স্বাধীনতা । তাঁর মননে গণতান্ত্রিক আদর্শ এতই সুদৃঢ় ছিল যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তেজো তাঁকে ১৯৪৩ সনে এক সভায় আগামী দিনের স্বাধীন ভারতের সর্বাধিনায়ক বলে সম্বোধন করলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করেন এবং বলেন যে নিজেদের নেতা নিযুক্ত করার দায়িত্ব ভারতবাসীর , এটা নিয়ে তাঁকে (জেনারেল তেজো) মাথা না ঘামালেও হবে ।
সমস্যা হল নেতাজী সময়ের কাজ সময়ে করার কথা বললেও বাস্তবে দেশে হয়েছে উল্টোটাই । স্বাধীনতার পর নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার পোষণ সযত্নে না করার ফলে আজও দেশের মানুষের মধ্যে প্রজাসুলভ মানসিকতা রয়ে গেছে । গণতন্ত্রে যে নাগরিকরাই ক্ষমতাকেন্দ্র একথা আজও দেশবাসীর কাছে অজ্ঞাত । গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধান উৎসব হয় নির্বাচন । অথচ সেই উৎসবই কিনা জাতি, ধর্ম, বর্ণভিত্তিক প্রচার , মদের রমরমা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার ঘৃণ্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় । জনসেবার পরিবর্তে আমরা ধর্ম, বর্ণ, ভাষিক পরিচয়ের ভিত্তিতে নিজেদের নেতা নির্বাচন করি । তারপর এই নির্বাচিত নেতারাই প্রতিদান হিসাবে আমাদের নাগরিক অধিকার খর্ব করার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন । প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বললেই নেমে আসে শাস্তির খাঁড়া । যে শাসন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল জনসেবা, সেই শাসন ব্যবস্থাই তখন শোষক হয়ে ওঠে । স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরও দেশের এই অবস্থার জন্য পূর্বতন শাসকরা যেমন দায়ী তেমনি একই ভাবে দায়ী বর্তমান শাসকরাও । নেতাজী দেশবাসীর মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনা উন্মেষের জন্য শৈশবেই গণতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত করার কথা বলেছিলেন, নব্য-স্বাধীন দেশের শাসকরা সেই পথ মাড়ান নি । আবার বর্তমান শাসকরা যেভাবে দেশের স্বার্থের কথা বলে নাগরিক অধিকার খর্ব করে চলেছেন নেতাজী কিন্তু তার পক্ষে কোনো কালেই ছিলেন না । তাঁর কথায় , “The political foundation of democratic philosophy is the supremacy of the people as the source of authority “ ।
