রাজ-সমাজ-অর্থ + নীতি
ভাবনায় নির্বাচন ২০২১
পর্ব ১৫
বিষয় : অসম বিধানসভা নির্বাচন ২০২১ এবং বাঙালি
নির্মলেন্দু রায়
৩১ মার্চ ২০২১
দেখতে দেখতে এসে পড়লো ৫ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন।
আসামের নির্বাচনের তারিখ ঠিক হয়েছে ২৭ মার্চ, ০১ এপ্রিল এবং ০৬ এপ্রিল।
বরাক উপত্যকায় নির্বাচন আগামী ০১ এপ্রিল ২০২১।
আসন্ন নির্বাচন কে সামনে রেখে "ঈশান কথা" পুরো মার্চ মাস ধরে আপনাদের সামনে তুলে ধরবে এই ধারাবাহিক
"ভাবনায় নির্বাচন ২০২১"
যাতে থাকবে নির্বাচনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই সমাজের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকা মানুষ এবং ছাত্রছাত্রী দের ভাবনাচিন্তা, মত-অভিমত, অথবা বিশ্লেষণমূলক লেখা ...
আজ পর্ব ১৫ ...
গত ২৭ মার্চ স্বাধীনতা পরবর্তী অসমের পঞ্চদশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট হয়ে গেছে। মধ্য অসমের শোণিতপুর জেলা থেকে উজানী অসমের সর্বত্র প্রথম দফায় ভোট হয়েছে।
গত ২৫ মার্চ বিকাল ৫টার সময় নির্বাচনের সমস্ত রকমের প্রচারকার্য সমাপ্ত হয়েছিল। অন্তিম দিনের অপরাহ্নে ছত্তিশগড়ের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিং তেজপুর শহরের এক জনাকীর্ণ মহল্লায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন মিত্রজোটের পক্ষে প্রচারে বেশ উষ্ণতা ছড়ায়েছিলেন। সভা শেষ হতেই তড়িঘড়ি করে সভাস্থল হতে যাবতীয় চেয়ার আদি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কারণ ততক্ষণে প্রচার কার্যের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। তারপর থেকেই এক থম ধরা নীরবতা বিরাজ করে। যেন কোন এক ঝড়ের আছড়ে পড়ার কিছু আগের স্তব্ধ পরিমণ্ডল! ঝড় কতটুকু উঠবে, বা আদৌ উঠবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু, প্রচার পর্বে খুব উদ্দামতা ছিল। গত ৭ মার্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢেকিয়াজুলির উপকণ্ঠে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে উদাত্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সভার পর হতেই বিজেপি কর্মীগণ 'হাও ইজ জোশ' টনিকে টগবগ করে উঠেছিলেন। কয়েকদিন পরে কংগ্রেসের প্রিয়ঙ্কা গান্ধীও তেজপুর শহরের হর্জর বর্মণ ক্রীড়াঙ্গনে প্রচার সভা করেন। সেই সভাতে বড়ো পিপলস্ পার্টির নেতা হাগ্রামা মহিলারীও উপস্থিত ছিলেন। এতে কংগ্রেসীগণ উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন। এর পরেই অসম রাজনীতির চাণক্য হিমন্ত বিশ্বশর্মা মিত্রজোটের প্রচারে যেন আধিঁ নিয়ে আসেন। অগপ সভাপতি অতুল বরা ও উপ-সভাপতি কেশব মহন্ত মিত্রজোটের অগপ প্রার্থী পৃথ্বীরাজ রাভার পক্ষে প্রচার করেন। এই সব বড় বড় প্রচার অভিযান ছাড়াও ভোট প্রার্থীগণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার যে কোন ছোট বড় জমায়েতকেও নিজেদের প্রচারের লক্ষস্থল করে তুলেছিলেন। ১৫ মার্চে তেজপুরের রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি উপলক্ষে কিছু ভক্তদের সমাগম হয়েছিল। একজন প্রার্থী সেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে অনায়াসে ভোট ভিক্ষা করলেন। তার আগে ২৭ ফেব্রুয়ারিতে তেজপুরের হরিসভাপাড়ায় রামকৃষ্ণ অনুরাগী মহিলাদের প্রতিষ্ঠান 'সারদা সঙ্ঘ'এর বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানেও অতি উৎসাহী দলীয় কর্মকর্তা নিজ পার্টির পাম্পলেট বিতরণে নিয়োজিত ছিলেন।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন মিত্রজোটের নির্বাচনী প্রচারে তেজপুরের বাঙালিগণ এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেন। বাঙালি যুবা-পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে, বলা যায় আবালবৃদ্ধবণিতা বিজেপি ও মিত্রজোটের প্রচারে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। প্রতি পাড়ায় পাড়ায় গলিতে গলিতে বাঙালি মহিলাগণ প্রচারের ঝড় তুলেছেন। একসঙ্গে দলবেঁধে প্রচার পর্বে দুই আঙুল দিয়ে 'ভিক্টরি সাইন' দেখিয়ে গ্রুপ ফটো তুলে সোসিয়েল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এরা যেন শুধু প্রচারই করলেন না, রীতিমত ব্যুহবদ্ধ হয়ে প্রতি বুথে বুথে নিজেদের দলীয় জোটের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটও নিশ্চিত করেছেন। প্রচারের এই ব্যাপকতায় এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে বিজেপি-মিত্রজোট নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে গেছে।
এরই মধ্যে তেজপুর সমষ্টিতে বিরুদ্ধমতের কিছু বুদবুদ্ও উঠেছিল। সোস্যাল মিডিয়াতে কেউ কেউ বলেছেন, 'Vote for NOTA'! এই বিরুদ্ধ মতের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে অনেক অনেক যথার্থ ভারতীয় নাগরিক 'ডি-ভোটার' হয়ে নাগরিক সুলভ ভোটাধিকার হারিয়ে বসে আছেন। এই ডি-ভোটারদের অনেকে ট্রাইব্যুনালের এক তরফা আদেশে 'ঘোষিত বিদেশী' হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পের নামে রাজ্যের বিভিন্ন জেলার জেলে বন্দী হয়েছিলেন। তিন বছর বা দুই বছরের বেশী সময় ধরে জেলবন্দী 'ঘোষিত বিদেশী'গণ সুপ্রীম কোর্টের হস্তক্ষেপের ফলে দুজন জামিনদারের সাহায্যে আপাততঃ জেল থেকে ছাড়া পেলেও তারা কিন্তু এখনও 'ঘোষিত বিদেশি' হয়েই আছেন। যে কোন সময় তারা আবার অন্তরীন হতে পারেন। তাছাড়াও, জামিনে অনেকের সাময়িক মুক্তিলাভ হলেও এখনও কয়েক হাজার হতভাগ্য 'ঘোষিত বিদেশি' জেলবন্দী হয়ে রয়েছেন। ২০২০ সালের ১৭ মার্চে মাননীয় কেন্দ্রীয় গৃহরাজ্যমন্ত্রী জি কিষেণ রেড্ডী লোকসভায় বলেছিলেন যে অসমের ৬টি বিভিন্ন জেলা জেলে মোট ৩৩৩১ জন 'ঘোষিত বিদেশি' রয়েছেন। ওই বন্দীদের অনেকেই যথার্থ ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্বেও নিছক অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও শিক্ষাগত অজ্ঞতার জন্যই এক তরফা আদেশে 'ডি-ভোটার' থেকে 'ঘোষিত বিদেশী' হয়ে জেলবন্দী হয়েছেন। এই লক্ষাধিক 'ডি-ভোটার' ও কয়েক হাজার 'ঘোষিত বিদেশি' ছাড়াও ১৯,০৬,৬৫৭ জন মানুষ এই সময় এন-আর-সি-ছুট হয়ে আছেন। এই সব এন-আর-সি-ছুটদের অধিকাংশই যথার্থ ভারতীয় নাগরিক। রাজ্যের সরকার এবং সব রাজনৈতিক দলগুলো তা জানে। কিন্তু, সব জেনে শুনেও সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বশীল বিচারবিভাগ, মন্ত্রীসভা এবং জননেতাগণ এই সব হাজার হাজার বছরের নিখাদ ভারতীয় ভূমিপুত্রদের ট্রাইব্যুনালের অস্বচ্ছ ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থাকে অত্যন্ত অস্বচ্ছ বলার মত যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ যাবৎ কোন ট্রাইব্যুনালের প্রসিডিং গুলোর ভিডিও রেকর্ডিং হয় নি। কোন রকম রেকর্ডিংএর অনুপস্থিতির সুযোগে ট্রাইব্যুনালের মেম্বারগণ নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনুসারে যে কোন ডকুমেণ্ট অগ্রাহ্য করে ডি-ভোটারদের ন্যস্তনাবুদ করে ছেড়েছেন। এই অস্বচ্ছতার ফলেই অনেকে 'ঘোষিত বিদেশি' হয়ে জেলবন্দী হয়েছেন। ভুক্তভোগী ডি-ভোটার এবং তাদের উকিলদের অনেকে এমন অভিযোগ করছেন। যার জন্য, অন্যায়ভাবে ঘোষিত বিদেশি দুলাল পালের জেলবন্দী অবস্থায় মৃত্যু হওয়ার পর সরকার নিয়োজিত ডি-আই-জি দেবাশিস মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন হাই-পাওয়ার কমিটি তেজপুরে এলে বাঙালি যুব-ছাত্র ফেডারেশনের তরফে দাবি করা হয়েছিল যাতে আগামীতে ট্রাইব্যুনালের পুরো প্রসিডিং গুলোর ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়। কিন্তু, এখনও এই বিষয়ে কোন সরকারী সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যায় নি। ডি-ভোটারদের এই জ্বলন্ত সমস্যার প্রতি শাসকীয় মিত্রজোট বা বিরোধী মহাজোটের কোন রাজনৈতিক দলের সামান্যতম ভ্রূক্ষেপ নেই। আর যারা এন-আর-সি-ছুট হয়ে রয়েছেন, তাদের কোন রকম সাহায্য না করে উল্টে বিজেপি নেতৃত্বাধীন মিত্রজোটের সরকার সেই ২০১৮ সালে সুপ্রীম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলেছেন কি না যে ওই এন-আর-সি-ছুট মানুষগুলো সকলেই না কি 'প্রাইমা-ফেসি-ফরেনার' অর্থাৎ, 'দৃষ্টতঃ বিদেশি'! এখানেই বিরুদ্ধ মতাম্বলী নাগরিকদের অভিমান। যে দলকে অকৃপনভাবে ভোট দিয়ে চোখের মণিরূপে শাসনাধিষ্ট করা হল, সেই দল কি না নিজের দলের একনিষ্ঠ অনুরাগীদের 'প্রাইমা-ফেসি-ফরেনার' বলে সর্বোচ্চ আদালতে হলফনামা দিয়েছে! এটা তো ভয়ঙ্কর ভাবে বিশ্বাসভঙ্গ! ইতিপূর্বেই এই বিশ্বাসভঙ্গ করেছে আগের শাসক গোষ্ঠীর মুখ্য নেতৃত্ব যথাক্রমে অগপ ও কংগ্রেস দলদ্বয়। অগপ দলই নীতি বহির্ভূত ভাবে সর্বপ্রথম ডি-ভোটার সৃষ্টি করেছিল। কংগ্রেস দল জেলের মধ্যেই ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করে 'ঘোষিত বিদেশি'দের গরু-ছাগলের মত সেখানে ভরে দিয়েছিল। সেই ক্যাম্প গুলোতে না ছিল স্বাস্থ্য সম্মত কোন ব্যবস্থা, আর না ছিল বন্দীদের মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য কোন রকম নীতি-নির্দেশানা। জেলের ভেতর চূড়ান্ত অব্যবস্থায় ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এক এক করে ৩০/৩১ জন জেল বন্দী অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। এই মৃত্যুর মিছিলের জন্য রাজ্যের বিভিন্ন সময়ের শাসনাধিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। এই বিশ্বাসভঙ্গতার জন্যই প্রথম দফার নির্বাচনের অন্তিম পর্যায়ে সোস্যাল মিডিয়ায় আলতো আওয়াজ উঠেছিল: ' Vote for NOTA'!
এই সময় সারা অসম রাজ্য জুড়ে লক্ষাধিক ডি-ভোটার রয়েছেন। ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম মোট ৩,৭০,০০০ জনকে ডি-ভোটার বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদের মধ্য থেকে ১,৯৯,৬৩১ জনের নামে কেস দর্জ করে বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালের কাছে ভেরিফিকেশনের জন্য পাঠানো হয়। তারপর একসময় সংবাদে জানা গিয়েছিল, ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারিতে অসম রাজ্য সরকার বিধানসভাতে এই বলে বয়ান জারী করে স্পষ্ট করেছিলেন যে সেই সময় বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল সমূহে মোট ১,৪৩,২২৭ জনের নাগরিকত্বের ভেরিফিকেশন চলছে। সেই ১৯৯৭ সাল থেকেই লক্ষ লক্ষ যথার্থ ভারতীয় নাগরিক বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ সফল হলেও অনেকেই নানা ছুঁতোনাতায় এখনও ডি-ভোটার হয়েই আছেন। এই হতভাগ্যগণ নাগরিকত্ব হারিয়ে না-ঘরকা আর না-ঘাটকা হয়ে বসে আছেন। ভূমিপুত্র হয়েও তারা দশকের পর দশক ধরে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যোগদান করতে পারছেন না। নাগরিকসুলভ অধিকারগুলোও ভোগ করতে পারছেন না। অথচ এই হতভাগ্যদের অধিকাংশই এই দেশের ভূমিপুত্র এবং সেই সুত্রে যথার্থ ভারতীয় নাগরিক।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে কোন রকম সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রায় ভোজবাজীতে লক্ষ লক্ষ 'ডি-ভোটার' তৈরি হয়েছিল! ঠিক যেভাবে ৩০ জুলাই ২০১৮ তারিখের ৪০,০৭,৭০৮ জন এন-আর-সি-ছুট ব্যক্তিগণ যখন পুনরায় নিজেদের দাবি সম্বলিত আবেদন পত্র জমা দিচ্ছিলেন, সেই প্রক্রিয়ায় আবেদন জমা দেওয়ার অন্তিম দিনে রহস্যজনকভাবে অজ্ঞাতব্যক্তিদের দ্বারা ইতিমধ্যেই এন-আর-সি-তে সামিল হওয়া কয়েক লক্ষ লোকদের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বার বার ভুক্তভোগীদের দ্বারা দাবি করা সত্বেও এন-আর-সি-কর্তৃপক্ষ এই আপত্তিদাতাদের নাম কখনও প্রকাশ করেন নি। লক্ষ লক্ষ ডি-ভোটার কখন, কিভাবে এবং কাদের তদারকিতে তৈরি হল, তা কেউ জানে না। বরপেটা জেলার জনিয়া ও কলগাছিয়া মহকুমার ৩৩ জন ডি-ভোটার ২০১৯ সালের জুন মাসে নির্বাচন কমিশনের পাবলিক ইনফরমেশন অফিসারের কাছে 'রাইট-টু-ইনফরমেশন' আইনে দরখাস্ত করে জানতে চেয়েছিলেন ঠিক কি পরিস্থিতিতে তাদের 'ডি-ভোটার' করা হয়েছিল। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে রাজ্যের স্টেট পাবলিক ইনফরমেশন অফিসার, সেখান থেকে জেলা প্রশাসন হয়ে সার্কেল অফিস পর্যন্ত চিঠি চালাচালি হয়। শেষ পর্যন্ত পরবর্তী নবেম্বর মাসে সার্কেল অফিস জানান যে ভোটার লিস্টে ৩৩ জন আর-টি-আই আবেদনকারীদের নামের পাশে সন্দেহজনক ভোটার রূপে 'ডি' চিহ্নটি ১৯৯৭ সালেই লাগানো হয়েছিল। কিন্তু ঠিক কি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে 'ডি-ভোটার' সাব্যস্ত করে ভোটার লিস্টে তাদের নামের পাশে 'ডি' মার্ক করা হয়েছিল, সেই বিষয়ে কোন রেকর্ড নেই। অর্থাৎ, স্পষ্টতই, কেউ বা কারা নাগরিকদের সম্প্রদায়গত পরিচয় দেখেই নিজেদের ইচ্ছেমত এই 'ডি' চিহ্ন গুলি লাগিয়েছেন! এটা তো রাজ্যের কার্যপালিকা পর্যায়ে এক অতি বৃহৎ কেলেঙ্কারি! এই ভয়ানক কেলেঙ্কারির রীতিমত তদন্ত হওয়া উচিত! কিন্তু দায়িত্বশীল একেবারেই গোষ্ঠী নির্বিকার!
ওই লক্ষ লক্ষ ডি-ভোটারদের মধ্যে যারা সামাজিক ভাবে সমর্থ ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক লোক নানা ভাবে আইনের সাহায্য নিয়ে নিজেদের নামের সঙ্গে থাকা ডি-ভোটার ছাপ মুছে ফেলতে পেরেছেন। কিন্তু, যারা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু তথা উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষার অভাবে সামাজিকভাবে নিতান্ত পশ্চাৎপদ ছিলেন, তারা আইনের সাহায্য নিয়ে নিজেদের 'ডি-ভোটার' কলঙ্ক মুক্ত করতে পারলেন না। উল্টে এক তরফা আদেশে 'ঘোষিত বিদেশি' হয়ে সোজা জেলে ঠাঁই পেলেন। বিজেপি ও মিত্রজোটের শাসনকালে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে প্রায় ১০২ বছর বয়স্ক কাছাড় জেলার চন্দ্রধর দাসও 'ঘোষিত বিদেশি' হয়ে শিলচর জেলে বন্দী হয়েছিলেন। এই হতভাগ্যদের কোন মানবাধিকার নেই। তাই, প্রাণ-সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় যে রোগীর চিকিৎসা আই-সি-ইউ'তে হওয়া উচিত ছিল, তেমন একজন রোগী 'ঘোষিত বিদেশী' ৬৫ বছর বয়স্ক দুলাল পাল নিতান্ত অবহেলায় এবং বিনা চিকিৎসায় গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজের বারান্দাতেই পড়ে ছিলেন কয়েকদিন। স্বর্গীয় দুলাল পালের ছেলেরা সর্বসমক্ষে তেমনই বলেছিলেন। গোয়ালপাড়া জেলের বন্দী উচ্চ রক্তচাপের রোগী ৭২ বছর বয়স্ক 'ঘোষিত বিদেশি' ফালু দাস ভুল ওষুধ প্রয়োগের ফলে বেঘোরে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবেই এক এক করে ৩০/৩১ জন অসহায় 'ঘোষিত বিদেশি' জেলবন্দী অবস্থায় মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে প্রথম দুজন ছাড়া বাকী সকলেরই মৃত্যু ঘটেছে বর্ত্তমান বিজেপি-মিত্রজোট সরকারের আমলেই। তাই এই সব অত্যাচারের যাবতীয় দোষ অবশ্যই এই বিজেপি-মিত্রজোট সরকারের উপরেই বর্তায়।
বর্ত্তমান বিধানসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে উপরে উল্লেখিত লক্ষাধিক ডি-ভোটার, কয়েক হাজার জেলবন্দী 'ঘোষিত বিদেশি' এবং কয়েক লক্ষ এন-আর-সি-ছুট ব্যক্তিদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিজেপি-মিত্রজোট এবং কংগ্রেস-মহাজোটের কোন কর্মসূচি নেই। এই অবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পোষণকারী সচেতন ভোটারগণ এই কর্তব্যে অবহেলাকারী রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলে কী খুব অন্যায় হবে! এই অসন্তুষ্টিতে তারা কেন এবার ইভিএম মেশিনে NOTA ছাপ দেওয়ার কথা ভাববে না!
তবে আসামের অধিকাংশ বাঙালি পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে রাত-দিন একাকার করে এই সময় বিজেপি দল ও মিত্রজোটের হয়ে খুব প্রচার করেছেন বা করছেন। এই ব্যাপারে তাদের উৎসাহ রীতিমত দেখার মত। অবশ্যই এটা কোন দোষের বিষয় নয়। সচেতন নাগরিকদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা খুবই ভাল কথা যে ভোট প্রচারের রাজনীতির সঙ্গে তারা ওতোপ্রতঃ ভাবে জড়িত হয়ে পড়েছেন। তেজপুরে NOTA নিয়ে সামান্য বুদবুদ উঠতেই বাঙালিগণ সমষ্টিগত ভাবে তার প্রতিরোধ করেছেন। ভোটের আগের দিন বাঙালিদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সমবেত হয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে কোন অবস্থাতেই NOTA বোতামে চাপ দেওয়া চলবে না। ভোট দিতে হবে শাসকীয় গোষ্ঠীকেই।
এই অবস্থায় আসামের বাঙালিদের কাছে অনুরোধ, অনুগ্রহ করে পাড়া-প্রতিবেশি এবং নিজেদের বিধানসভা সমষ্টিকে সামনে রেখে এই প্রশ্ন গুলোর জবাব সন্ধান করুন। নিজেদের বিধানসভা সমষ্টির সমস্ত বাঙালিদের নাম কি এন-আর-সি'তে এসে গেছে? যদি কিছু মানুষের নাম না এসে থাকে, তাহলে সেই সব মানুষ কি ভারতীয় নয়? যদি সেই সব এন-আর-সি-ছুট মানুষগুলোর অধিকাংশ যথার্থ ভারতীয় হয়ে থাকে, তা হলে বিজেপি দল সেই সব মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে আবার NSK লেভেলে কাগজপত্র পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করে নি কেন? এই এন-আর-সি-ছুট মানুষগুলোর সংখ্যা যখন ২০১৮ সালের ৩০ জুলাইতে প্রকাশিত খসড়ায় প্রথম দফায় ৪০ লক্ষের কিছু বেশি ছিল, তখন বিজেপির সর্বশক্তিমান নেতা অমিত শাহ তাদেরকে 'ঘুসপেটিয়া' ও 'উইপোকা' বলেছিলেন কেন? বিজেপির নিয়ন্ত্রণাধীন অসম সরকার সেই ৩০ জুলাই ২০১৮ তারিখের প্রথম দফার প্রায় ৪০ লক্ষ এন-আর-সি-ছুট মানুষদের 'প্রাইমা-ফেসি-ফরেনার' বলে সুপ্রীম কোর্টে এফিডেবিট দায়ের করেছিলেন কেন? অথচ, সেই প্রথম দফার এন-আর-সি-ছুট ৪০ লক্ষের প্রায় অর্ধেকের নাম ২০১৯ সালের ৩১ আগষ্টে প্রকাশিত চূড়ান্ত খসড়াতে সামিল হয়ে গেছে। নতুন করে এন-আর-সি-ছুট হওয়া ১৯,০৬,৬৫৭ জন ব্যক্তিদেরও অধিকাংশ যথার্থ ভারতীয়। বিজেপি দল এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়েও যথার্থ ভারতীয় নাগরিকদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না কেন? ডি-ভোটার ইস্যুতে নাজেহাল ও অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত দুর্বল এবং সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ গরীব ভারতীয় ভূমিপুত্রদের বিজেপি দল কোনরকম সাহায্য করছে না কেন? অর্থনৈতিক দুর্বলতার জন্য আইনের সাহায্যে যারা নিজেদের দোষমুক্ত করতে না পেরে ট্রাইব্যুনালের এক তরফা বিচারে 'ঘোষিত বিদেশী' হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পের নামে জেল বন্দী হয়েছে, সেই হতভাগ্যদের জন্য বিজেপি দল কোন আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করে নি কেন?
ভাগ্যের দোষে 'ঘোষিত বিদেশি' হয়ে জেলে বন্দী অবস্থায় রোগাক্রান্ত হয়ে একে একে ৩০/৩১ জন জেলবন্দী' বেঘোরে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই ৩০/৩১ জনের অধিকাংশ অসমে বিজেপি দলের শাসনকালেই মারা গেছেন। কেন এমন হল? জেলবন্দীদের প্রতি বিজেপি দলের সরকারের কোন দায়িত্ব নেই কেন? তেজপুর জেলের বন্দী তথাকথিত 'ঘোষিত বিদেশি' দুলাল পালের মৃতদেহ নিয়ে অনেক চাপান-উতোর হলে অসমের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহোদয় মৃতের পরিবারবর্গকে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতিও পালন হয় নি কেন? এন-আর-সি-তে যাদের নাম ইতিমধ্যেই এসে গেছে, এমন লোকদের নামে এই করোনাকালেও বিজেপি সরকারের আমলেই আবার নতুন করে ডি-ভোটার নোটিশ দেওয়া হচ্ছে কেন? করোনা সঙ্কটের মধ্যেই গত ২৮ জানুয়ারিতে ধেমাজী জেলার মনোরঞ্জন মণ্ডলকে 'ঘোষিত বিদেশি' রূপে তেজপুর জেলের ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে দেওয়া হল কেন? অথচ, তাঁর পরিবারের অন্য সকলেই যথার্থ ভারতীয় নাগরিক! বাঙালিদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে হবে! Vote for NOTA কোন অবাঞ্ছিত ইচ্ছা হতে পারে না। কারণ, যথার্থ ভারতীয় নাগরিকগণ ষড়যন্ত্রকারীদের ছলনায় 'ডি-ভোটার' হয়েছেন। এই ডি-ভোটারদের অনেকে আবার 'ঘোষিত বিদেশি' হয়ে জেলবন্দী হয়েছেন এবং কয়েক লক্ষ নাগরিক এন-আর-সি-ছুট হয়ে গত দুবছর ধরে ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে এই নির্বাচনের পরই এন-আর-সি-ছুট মানুষদের ট্রাইব্যুনালের দরজায় দরজায় চক্কর দিতে হবে। যথার্থ নাগরিকদের এভাবে পর্যুদস্ত করা হচ্ছে এবং আগামীতে আরো পর্যুদস্ত করা হবে। কিছু নাগরিক এই ভাবে লাঞ্ছিত হবে, আর অন্য সব নাগরিক শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবে! কোন উচিত প্রতিক্রিয়া দেখাবে না! কোন প্রতিবাদ করবে না! এটাই গণতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ! প্রায় ২০/২২ বছর ধরে বাঙালিদের উপর এই অত্যাচার চলছে। অত্যাচারে জর্জরিত লোকদের
জন্য বিজেপি-মিত্রজোট এবং কংগ্রেস-মহাজোট বা অন্য দলের কোন কর্মসূচি নেই। এই অবস্থায় NOTA হচ্ছে ডুবন্ত মানুষের হাতের সামনে সামান্য খড়-কুটো, যা ছাড়া প্রাণ বাঁচানোর আর কিছুই নেই।