রাজ-সমাজ-অর্থ + নীতি
ভাবনায় নির্বাচন ২০২১
পর্ব ৭
বিষয় : আসন্ন নির্বাচন ও ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালিদের ভবিষ্যৎ ...
পঙ্কজ কান্তি মালাকার
২১ মার্চ ২০২১
দেখতে দেখতে এসে পড়লো ৫ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন।
আসামের নির্বাচনের তারিখ ঠিক হয়েছে ২৭ মার্চ, ০১ এপ্রিল এবং ০৬ এপ্রিল।
বরাক উপত্যকায় নির্বাচন আগামী ০১ এপ্রিল ২০২১।
আসন্ন নির্বাচন কে সামনে রেখে "ঈশান কথা" পুরো মার্চ মাস ধরে আপনাদের সামনে তুলে ধরবে এই ধারাবাহিক
"ভাবনায় নির্বাচন ২০২১"
যাতে থাকবে নির্বাচনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই সমাজের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, লেখক, বিভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকা মানুষ এবং ছাত্রছাত্রী দের ভাবনাচিন্তা, মত-অভিমত, অথবা বিশ্লেষণমূলক লেখা ...
আজ পর্ব ৭ ...

আসতে চলেছে অসমের বিধানসভা নির্বাচন, কাছাড় প্রশাসন ডলু শিলচর মহাসড়কে আট কিলোমিটার দীর্ঘ আলপনা এঁকে বিশ্বরেকর্ড গড়ে ভোট দিতে উৎসাহিত করেছেন, আমরা সবাই ভোট দিতে যাব এবং সাথের জনকে ডেকে নিয়ে যাব। তা তো ঠিক আছে নিজে যাব পাশের জনকে ডেকে নিয়ে যাব কিন্তু গিয়ে কাকে ভোট দেবো এবং কেন দেবো জেনেবুঝে সিদ্ধান্ত নিয়েই তো যেতে হবে ভোটকেন্দ্রে। আমি একজন ভারতীয়, অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকাবাসী, হিন্দু বাঙালি, আমার অবস্থান থেকে ও আমার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালিদের প্রেক্ষাপটে আমার ভাবনা তুলে ধরছি।
গত পাঁচ বছর অসমের শাসনভার সামলিয়েছে BPF ও AGP সমর্থিত BJP দল। এছাড়া কংগ্রেস, AIUDF, BDF, বাম, রাইজর দল ও অন্যান্য আঞ্চলিক দল বা নির্দলীয় প্রার্থীরা। এদের মধ্যে কাদের আমরা ভোট দেবো এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু তার জন্য যৌক্তিক সিদ্ধান্তের প্রস্তুতি নিতে হবে। গত পাঁচ বছরের রাজ্য সরকারের কার্যকলাপ বিচার করেই আগামীদিনের তাদের চাই কি এবং কেন চাই? আর যদি আগামীদিনের জন্য অন্য কাউকে চাই তো তাদের যথার্থ বিকল্প কে। যদি সরকারের বদলে বিকল্পের প্রয়োজন হলো তবে তা কেন এবং তারা সেই চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম তো?
আমাদের বরাক উপত্যকা অসম রাজ্যের সবচেয়ে অনুন্নত ভৌগলিক ক্ষেত্র কিন্তু সম্ভাবনা পূর্ণ। হিন্দু বাঙালির বড়ো অংশ বিচ্ছিন্নভাবে সম্পূর্ণ অসম জুড়ে রয়েছেন। জাতি হিসেবে হিন্দু বাঙালি দেশভাগের শিকার বা ভূমিপুত্র হিন্দু বাঙালি তৎপ্রভাবিত, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে অসমে অধঃপতিত ও নিপীড়িত জাতি। আমাদের শুধু উন্নয়নের টোপের ডাকে সাড়া দেওয়া আত্মঘাতী হবে। আমাদের সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক ও বৌদ্ধিক উন্নতির সাধন আমাদের অনিবার্য চাহিদা। যা ন্যায়সঙ্গত।
বিগত রাজ্য সরকারের হিন্দু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০২০ এর বিরোধিতার প্রতি নরম মনোভাব পোষণ, অসমের সর্ববৃহৎ মাতৃভাষাগোষ্ঠী বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে ও রাজ্যভাষা করার দীর্ঘদিনের দাবিকে অদেখা করে অন্য একটি ভাষাকে সহকারী রাজ্য ভাষার সন্মান প্রদান, এসব কি বিগত সরকারের কৃত্রিম বৃহৎ অসমিয়া জাতি নির্মাণের নীরবকৌশল নয় কি? উচ্চ মাধ্যমিকের স্কুলপাঠ্য 'বৈচিত্র্যপূর্ণ অসম' গ্রন্থে অসমের প্রায় সবকটি জনগোষ্ঠীর উল্লেখ-সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও অসমের ইতিহাসে সেই জনগোষ্ঠীওদের ব্যাক্তিত্বদের অবদানের উল্লেখ রয়েছে,বরাকের জনগোষ্ঠী শিরোনামে বিশিষ্ট লোক-গবেষক শ্রদ্ধেয় ডঃ অমলেন্দু ভট্টাচার্য্য মহোদয়ের একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ রয়েছে, তিনি সেই প্রবন্ধে বরাকবাসী সকল সম্প্রদায়ের সংক্ষেপে উল্লেখ ও বর্ণনা করেছেন কিন্তু সমগ্র অসমের সর্ববৃহৎ একক জনগোষ্ঠী বাঙালির পৃথক কোন প্রবন্ধের'ই আয়োজন নেই, এই বিশাল শিক্ষাকার্যক্রমে, এতে কি শিক্ষা জগত থেকেই অসমে বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতি অবজ্ঞা ও অদেখা করার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না তো? না কি সুকৌশলে শিক্ষাকালীন যুগ থেকেই বাঙালিত্বকে অস্বীকার করে বৌদ্ধিকভাবে নীরবে কৃত্রিম বৃহৎ অসমিয়া গোষ্ঠীতে বাঙালিকে বিলুপ্ত করার প্রয়াস নয় তো?
সামাজিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষার নীরব আকাঙ্খায় হিন্দু বাঙালি জাতি স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সহজ ভোটব্যাঙ্ক এবং এক বিরাট ভোটব্যাঙ্ক। আসামের অনেকটি বিধানসভা কেন্দ্রে হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায় নির্ণায়ক শক্তি। অঘোষিত হিন্দুত্ববাদী শক্তি হিসেবে ভা.জ.পা. নীরবে হিন্দু বাঙালির ভোটের দাবি রাখে অপরপক্ষে ঘোর প্রাদেশিক আন্দোলনের মুখ অ.গ.প এর সঙ্গে মিত্রজোট, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দেশভাগের বলি ছিন্নমূল হিন্দু বাঙালির মূখ শিলাদিত্য দেবকে বিধায়কের টিকেট না দেওয়া তো হিন্দুত্ববাদী শক্তির পরিচয় হতে পারে কি? সর্বভারতীয় স্তরে ভা.জ.পা. এর যে নীতি প্রদর্শিত অসম প্রদেশে ভা.জ.পা. য় তা প্রাদেশিক আন্দোলনের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় নি তো?
বিগত সরকারের একটি বড় গুণ লক্ষণীয় যে সরকার পক্ষের দুর্নীতির কোন দুঃসংবাদ আসে নি, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা শোনা গেলেও।পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে নিশ্চয়, কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রয়াসে। রাস্তাঘাট, পাকা সেতু ইত্যাদির নির্মাণ, হাসপাতাল ভবন নির্মাণ ও সিট বৃদ্ধি, প্রত্যন্ত অঞ্চলে কয়েকটি নতুন সরকারি কলেজ নির্মাণ, বিগত দিনে কয়েকশতাধিক স্কুল কলেজ প্রাদেশিকরণের প্রথম তালিকা প্রকাশ, আঠাশ হাজার টেট শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি উল্লেখনীয়। কিন্তু বলা বাহুল্য তুলনামূলক ভাবে সরকারের প্রথম তিন বছরের কাজের গতি অত্যন্ত ধীর ছিল, সরকারের দিগ্বজ নেতারা ভিনরাজ্যের সরকার নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন, কা বিরোধী আন্দোলনে সমগ্র রাজ্যের থমথমে পরিস্থিতি ছিল এইধরনের গতাগতির কপালে এসে জুটলো করোনা মহামারীর প্রকোপ, অবশ্য মহামারীর কালে কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ শক্তি ও প্রদর্শন প্রশংসাযোগ্য, দুর্নীতিমুক্ত কেন্দ্রের ত্রাণ বিতরণ, পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিন রাজ্য থেকে আনার ও কোয়ারেন্টিন বন্দোবস্ত, করোনা সংক্রমিতদের কোয়ারেন্টিন ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত, রাজ্য সরকারের কর্মীদের দ্বারা নিম্নবিত্তের মধ্যে ত্রাণ সাহায্যে প্রণোদনা প্রদান সত্যিকার অর্থে সাধুবাদযোগ্য।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ভোটের আগে রাজ্য সরকার যেন অতি তৎপর হয়ে উঠেছে, আর্থিক অসচ্ছলদের মধ্যে মাসিক সামান্য আর্থিক সাহায্য প্রদানে অরুণোদয় প্রকল্প একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, এমন কিছু আর্থিক অনুদানের প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে, সরকারের অনেক উন্নতিমূখী প্রকল্পের সদ্য শিলান্যাস হলো মাত্র- যেমন ষোলটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, দুটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আটটি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল হসপিটাল ও কলেজ, বঙ্গাইগাঁওয়ে গ্যাস প্রকল্প ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এতগুলো শিক্ষা ও সেবামূলক সংস্থার মধ্যে শুধু একটি ডেন্টাল কলেজ পাচ্ছে বরাকভেলি শিলচরে, দীর্ঘদিনের দাবি করিমগঞ্জ হাইলাকান্দি অঞ্চলে একটি মেডিকেল কলেজের, পাঁচটি মেডিকেল কলেজের মধ্যে একটিও কি বরাকের কপালে জুটলো না যেহেতু বরাকের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তুলনামূলক অনেক অনুন্নত, এসব কি বরাকের প্রতি অবহেলা বা অসামঞ্জস্য নয়? ধলাইয়ে জীব বৈচিত্র্য পার্ক নিশ্চয়ই একটি বিজ্ঞানমনস্ক প্রকল্প বা শিলচরে মিনি সচিবালয় তো প্রাশাসনিক সুবিধায় নির্মাণ, এতে বরাকের সর্বসাধারণের কি লাভ? জেলা গ্রন্থাগার সমূহের উন্নতিকরণ শুধু কি প্রেক্ষাগার সমূহের নবনির্মাণে সীমিত থাকবে না কি গ্রন্থাগারের ও গ্রন্থভাণ্ডারের'ও উন্নতি সাধিত হবে? প্রসঙ্গক্রমে বলি অসমের সকল সাহিত্য সভাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হলো শুধু কোন বাংলা সাহিত্য সংস্থা ব্যতীত তা কি বঞ্চনা নয়, এটা বঞ্চনা থেকে বড় অপমান- সেদিন কেউ এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়নি আর এখন নির্লজ্জের মতো সকল রাজনৈতিক দল এক বাঙালির তৈরি গান 'খেলা হবে' থেকে স্লোগান তুলছেন, যদিও বাঙালি জাতি স্বতোপ্রণোদিত নিজের শিল্পসংস্কৃতিতে এগিয়ে যাবে তবু কি সরকারি সহায়তার আশা রাখতে পারে না?
এছাড়া হিন্দু বাঙালিকে মনে রাখতে হবে কংগ্রেস বাম সহ সকল আঞ্চলিক দল প্রকাশ্যে হিন্দু নাগরিকত্ব আইন বিরোধী অবস্থানে প্রকট এবং আঞ্চলিক দলগুলি ঘোর প্রাদেশিক। কয়েকটি আঞ্চলিক দল মিলে যে মহাজোট করেছে তাদের পরিকল্পনা নিছক প্রাদেশিকতা ও উন্নয়ন। আমাদের চাহিদা দ্বিমূখী এক ছিন্নমূল বাঙালির সামাজিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষা প্রদান ও দ্বিতীয় আর্থিক শিক্ষা-সেবা পরিকাঠামোগত উন্নয়ন উভয়েই। অতএব মহাজোট ঘোর প্রাদেশিকবাদ নিয়ে তো আর বাঙালির স্বার্থে কাজ করবেনা এটাই স্বাভাবিক। তবে বরাকে বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, তবে তাদের প্রচারে জোর নজরে পড়ছে না, এই দল প্রকাশলগ্নে বরাকের ও বরাকবাসীর বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হয়েছে, বরাকের কথা তুলে ধরতে আমরা বরাকবাসী এই দলটিকে নিয়েও ভাবতে পারি। এই প্রবন্ধ লেখা অবধি তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হয়নি, হয়তো শীঘ্রই প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হবে তাদের পেজ থেকে জানতে পারলাম। আমার ব্যাক্তিগত সমীকরণ যদি আমাদের বহুমাত্রিক সমস্যা তুলে ধরার মতো দল বা প্রার্থীকে বিরোধী আসনেও রাখা যায় তবে তা অনেক কার্যকারী হতে পারে।
এই নির্বাচনে বরাকে অভিজ্ঞ বিধায়ক ও তাদের কার্যকালে সক্রিয় জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন এমন কিছু প্রার্থী রয়েছেন, তাদের প্রতি সুনজর রাখা উপত্যকা ও জাতির প্রতি মঙ্গলময় হতে পারে। একজন কর্মঠ নেতা বা তার কার্যকালে জনমনে সন্তুষ্টি থাকে তেমন নেতাদের সুযোগ দিলে আগামী দিনের তাদের বিগত অভিজ্ঞতায় আরো সেরা সেবা প্রদান করতে পারবেন।
বিজেপির হয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রচারে বরাকে এসে বরাক ব্রহ্মপুত্র সমন্বয়ের কথায় জোর দিয়েছেন, শুধু ভাষণে বন্দী না রেখে প্রকৃত সমন্বয় ও সমদৃষ্টি কার্যে প্রতিফলিত করা হোক। বাঙালি জাতিসত্ত্বার পরিচয়কে অক্ষুন্ন ও সুরক্ষিত রাখতে সরকারের ক্রিয়াশীল পদক্ষেপের দাবি করা হোক, বরাকের যোগাযোগ স্বাস্থ্য শিক্ষাদি ব্যবস্থার উন্নতির দাবি হোক, বরাকের একমাত্র ভারী শিল্প কাগজকলের পুনরুজ্জীবন ও শিলচর মেডিকেল কলেজের সার্বিক উন্নতির দাবি হোক ইত্যাদি। বাংলাকে অসমের সহকারী রাজ্যভাষা করা, ভাষা শহীদদের শহীদের সন্মান প্রদান, শিলচর রেলস্টেশনের নাম "ভাষাশহীদ স্টেশন"এর নামে পরিবর্তন দাবি হোক। জনগণ আমাদের সার্বিক উন্নতির পক্ষধরদের নির্বাচিত করবেন আশা রাখছি।
জয় ভারত।