গল্প - ৪
তুলসী
মিথিলেশ ভট্টাচার্য্য
দুপুরবেলা বাড়িতে ঢুকেই ভাইপো নবীন আমাকে সামনে পেয়ে বলল, জানো জেঠু, তুলসী খুব কাঁদছে দেখে এলাম—৷
কোথায় দেখে এলি? আমি উদ্বেগের সুরে প্রশ্ন করি৷
ওই তো রাস্তার পাশে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে—৷
ওর সঙ্গে সোনালি নেই?
মাসীমনি সঙ্গেই আছে৷ একটু হলেই তুলসী নাকি বাইরের নিচে পড়ত৷ তাই মাসীমণি ওকে বকেছে, একটা চড়ও মেরেছে—৷
খুব জ্বালাতন না করলে সোনালি তুলসীকে বকে না, গায়ে হাত তো অনেক দূরের কথা৷ তবে আজ ঘটনাটা খুব গুরুতর৷ একটা কিছু যদি ঘটতো তাহলে তুলসীর বাবা-মাকে কী জবাব দিত সোনালি৷ যত বড় হচ্ছে তুলসী ততো ওর চঞ্চলতা, দুষ্টুমি এসব বাড়ছে৷ সোনালি সে ওকে কীভাবে সামলায় তাতো আমি বেশ ক’দিন ধরে দেখছি৷
আমাদের দু’জনের সংসারে অনেকদিনের পুরনো কাজের দিদি ছায়া গোয়ালার চোখের ছানি কাটার দরুণ ক’দিন ওকে বিশ্রাম দিতে হয়েছে৷ আমাদের পূর্বপরিচিতা৷ সোনালিকে ওই ক’দিন দুবেলা রান্না কাজ করে দিতে বলেছিলাম৷ সোনালি যেদিন সকালবেলা রান্না কাজ করতে েলো সেদিন সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল তুলসীকে৷ ফুটফুটে একরত্তি বাচ্চাটিকে দেখেই আমার খুব ভাল লেগে গিয়েছিল৷ গোলগাল চেহারা, রং সামান্য চাপা, নাক একটু চ্যাপ্টা, মাথার চুল বব ছাট, মুখটা ভীষণ মিষ্টি, পরণে হালকা গোলাপি রংয়ের জামা৷ বয়স চার-সাড়ে চার৷ সোনালির সঙ্গে চেহারার বেশ মিল৷ যদিও তুলসী ওর কোন আত্মীয় না, সোনালির মালকিন মিসেস সিন্হার একমাত্র মেয়ে৷
সোনালির আঁচল ধরে ঘরে ঢুকে ওর আঁচলের ছায়াতেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তুলসী৷ আমি ওকে দেখামাত্র মৃদুস্বরে সস্নেহে হাত নেড়ে ডাক দিলাম, এদিকে আয় তো—!
আমার ডাক শুনে সে নড়ল না৷ যথারীতি দাঁড়িায়ে রইল সেনালির আঁচলের ছায়ায়৷ তখন ওর শরীরে মৃদু নাড়া দিয়ে সোনালি ওকে বলল, যা না তুলসী, আঙ্কেল তোকে ডাকছে তো—!
তবু তুলসী নড়ল না৷ স্থির চোখে ভাবলেশহীন চেহারায় আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ যেন ওর শিশুমন আমার আন্তরিকতা পরখ্ করছে৷ আমি আবার দু’হাত সামনে বাড়িয়ে সস্নেহে ওকে ডাকি, আয়, কাছে আয়—৷
এবার তুলসী মাথা তুলে সোনালির মুখের দিকে তাকাল অর্থাৎ তখন সে বললে তুলসী আমার কাছে আসবে৷ সোনালি সাথে সাথে ওকে মৃদু ঠেলা দিয়ে বলল, যা কাছে যা, আঙ্কেল কত ভালো, তোকে কত আদর করবে, চকলেট দেবে—৷
এবার গম্ভীরভাব কেটে মুখে একটু হাসি ফুটল তুলসীর, ঘোরবর্ণ মেঘ কাটা চিলতে রোদের মতো৷ আমি ওর দিকে দু’হাত বাড়ালাম৷ ও ধীরে ধীরে আমার কাছে সরে এলো৷ আমি খুব আদুরে সুরে বললাম, তোমার নাম কী বলতো?
তুলসী৷
বাহ্ খুব সুন্দর নাম তো!
কালকে আমার বার্থ ডে, তুমি যাবে?
তাই নাকি, নিশ্চয়ই যাব৷ হ্যাপি বার্থডে টু য়্যূ!
থ্যাঙ্কয়ূ৷ তুলসী চটপট উত্তর করে৷
আমি তো কেইক কাটব, সবাই আমাকে গিফট দেবে—৷ তুলসী আবার বলে৷
আমিও— তোমাকে গিফট দেবো৷ কী গিফট চাই তোমার?
তুমি—তুমি আমাকে একটা ডল দেবে— আর—৷
আর কী দেবো?
অরেঞ্জ চকলেট৷
তুলসী অরেঞ্জ চকলেট খেতে খুব ভালোবাসে৷ তবে একটা পেলেই খুশি৷ সোনালি ওর দিকে তাকিয়ে বলে৷
আমি বলি, ঠিক আছে, তোমাকে একটা চকলেট এনে দেব—৷ একথায় তুলসীর মুখে বেশ হাসি ফুটে৷ তবে অন্য বাচ্চাদের মতো এক্ষুনি এনে দিতে বায়না ধরে না৷
তুলসীর তো রোজ জন্মদিন—৷ সোনালি ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে৷
তাই বুঝি, খুব ভালো তো—! আমিও হাসির সঙ্গে বলি৷
কালকে আমার বার্থ ডে—৷ স্ফূর্তির সুরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে তুলসী৷ তারপর আমার দু’হাতের আল্গা বাঁধন ছাড়িয়ে একছুটে চলে যায় আমাদের শোবার ঘরে৷ দু’মুহূর্ত পরেই আমার কাছে দৌড়ে আসে৷
আংকেল আন্টি কোথায়—?
আন্টি—! আমি কেটু থমকে গিয়ে নিষ্পাপ শিশুর মুখের দিকে তাকাই৷ চট করে কোন কথা যোগায় না আমার মুখে৷
ওই ঘরে আমি আন্টির ছবি দেখেছি—!
আন্টিতো নেই, চলে গেছে,—আমি কোনরকমে বাষ্পরুদ্ধ সুরে বলি৷
কোথায় চলে গেছে আমার আন্টি? তুলসীর অবোধ প্রহ্নের কী জবাব দেব আমি!
বাবা, আন্টিতো আকাশের তারা হয়ে গেছে,—সোনালি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে৷
আর আসবে না বুঝি—?
আকাশের তারা হলে কেমন করে আসবে? সোনালি তুলসীকে বলে৷
তুমি ওকে ফোন করো না আংকেল—!
আচ্ছা করব৷
মোবাইল নিয়ে এখন কথা বলো—৷ টেবিলের ওপর পড়ে থাকা মোবাইল দেখিয়ে তুলসী বলে৷
আমি ওর কথায় মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে কানে লাগাই৷
তারপর আদ্র্রকণ্ঠে বিদেহি নীলিমার উদ্দেশ্যে বলি, হ্যালো,
তুমি কোথায় আছো—!
তুলসী তার ফুলের মতো সুন্দর মুখটি সামান্য গম্ভীর করে আমার দিকে তাকিয়ে রয় একটুক্ষণ৷
তারপর বলে, আন্টি কথা বলছে না—?
না৷ বলছে না তো—৷
আন্টি গুস্সা হয়ে গেছে৷ কথা বলছে না, আসছে না—!
তুলসীর এই কথা শুনে ভারাক্রান্ত মনে আমি ভাবি, নীলিমা৷ তো সুস্সা করেনি, ভয়ঙ্কর এক ব্যাধির বিষ দংশনে সে অকালে ছেড়ে গেছে আমাকে, ওকে তো আর কোনোদিন এ সংসারে ফেরাতে পারবো না৷ কথাগুলো দুধের শিশু তুলসীকে কেমন করে বুঝিয়ে বলি আমি৷
আবার ডাক না আন্টিকে—৷ তুলসী খুব আদুরে সুরে বায়না করে৷
আন্টি খুব সুন্দর নারে তুলসী,—সোনালি ওকে ভোলানোর চেষ্টা করে৷
খুব সুন্দর আমার আন্টি—৷ তুলসী আহ্লাদী গলায় বলে৷
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই৷
তুমি কোথায় যাবে আংকেল?
একটু বাথরুমে যাব৷
আমিও যাব—! বলে তুলসী ওর কচি দুখানা হাত দিয়ে আমার হাত অাঁকড়ে ধরে৷ আমি স্মিত হেসে সোনালির দিকে তাকাই৷ তুলসীর আচরণ অবিকল আমার নাতনি রিমঝিমের মতো৷ যে কদিন ছিল আমাদের বাড়িতে নিলিমা আর আমার সঙ্গে ছায়ার মতো লেপ্টে ছিলো৷
দু’জনের কেউ একা কোথাও যেতে পারতাম না, কাজ করতে পারতাম না৷
চল আঙ্কেল—তুসী আমাকে তাড়া দেয়৷
এখন যাব না,—আমি ওর আব্দার থেকে রেহাই পেতে বলি৷
চল, এখন পড়তে বসি,—তুলসী নাছোড়ের মতো সেঁটে থাকতে চায় আমার সঙ্গে৷
আসোনা আঙ্কেল,—আমার হাত ধরে টানতে থাকে তুলসী৷
আমার স্টাডিরুমে আগেই দেখেচে ও৷ ওখানে দুটি কাঠের চেয়ার ও ছোট বড়ো দুটি টেবিল আছে৷ টেবিলে ছড়ানো বইপত্র, খাতা, কাগজ, বেশ কটা কলম, পেপার ওয়েট ইত্যাদি গতকাল তুলসী একটি চেয়ারে বসে খাতা কলম নিয়ে বিভর আঁকিবুকি করেছে৷ আজও বোধহয় তাই করতে চায়৷ আমি সোনালিকে একটু চা করতে বলে তুলসীকে নিয়ে স্টাডি রুমে যাই৷
তুলসীকে চেয়ারে বসিয়ে কাগজ কলম হাতে ধরিয়ে দিই৷ তারপর বেরিয়ে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াই৷ এখন একটু সময় অন্তত তুলসী কাগজ-কলম নিয়ে মত্ত থাকবে৷ কিন্তু আমার ধারণা যে ভ্রান্ত তা প্রায় দু’চার মুহূর্ত পরই টের পেলাম৷ কাগজ-কলম ছেড়ে তুলসী বারান্দায় এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে৷ দাঁড়িয়েই ক’হাত দূরের গোলাপ গাছের দিকে তাকিয়ে বলে, আঙ্কেল, এই রোজ্টা আমাকে দেবে—!
গাছের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ে ওটি নীলিমার জন্য গুয়াহাটি থেকে নিয়ে এসেছিল অসমীয়া ছেলে বুবুল৷ সে ছিল পলিটেকনিকের ছাত্র, ভাড়াটে হিসেবে থাকতো আমাদের বাড়িতে৷ নীলিমার অক্লান্ত যত্ন-অত্তিতে গাছটি খুব সুন্দরভাবে বেড় উঠেছে৷ প্রতিবছর দেদার রক্ত গোলাপ ফোটে গাছটিতে৷ কেউ হাত ছুঁহয়ে গোলাপ পাড়লে নীলিমা ভীষণ রাগ করত৷ গুচ্ছ রক্তগোলাপের বেশ কটি ছবি আছে আমার মোবাইলে৷
ঘরের ভিতর থেকে তুলসীর বায়না শুনে সোনালি বারান্দায় বেরিয়ে এসে ওর পাশে দঁড়িয়ে বলে, বাবা, বলেছি না, রোজ্ পাড়তে নেই, ওটা গাছে থাকলেই সুন্দর দেখায়—!
তখন তুলসী আমাকে বলে, তাহলে তুমি আমাকে একটা গাছ দাও, আমিম ঘরে নিয়ে যাব—!
ঠিক আছে দেব৷ আচ্ছা, বলতো তুলসী ওকে কী বলে ডাক তুমি? আমি সোনালির দিকে তাকিয়ে বলি ওকে৷
ওটা তো মা,—বলেই দু’হাত ডানার মতো মেলে সোনালিকে জাপ্টে ধরে৷
বলতো তোমার কয়টা মা?
আমার দুইটা মা,—অনায়াসে বলে তুলসী৷
দুইটা মা—!
হ্যাঁ তো৷ একটা মা অফিসে যায়, আর এই মা-টার কাছে আমি থাকি—৷ খুব আহ্লাদের ভঙ্গিতে বলে তুলসী৷
জানো মেসো, তুলসী স্কুলেও বলে ওর দুটি মা—৷ সোনালি হাসিমুখে বলে৷
তুমি স্কুলে যাও নাকি তুলসী?
হ্যাঁ৷ যাই তো৷ আমার প্লে স্কুল৷
তোমার পাপা তোমাকে আদর করে?
করে তো৷ পাপা কুচু কুচু (কুতু কুতু) করে আমি হাসি৷
মাও করে—দাদুও করে৷ জানো আঙ্কেল অমার ববের ঘরে একটা আন্টি আছে, একটা অচিনা (অবেশিকা) আছে, আমি ওর সঙ্গে খেলি,—৷
কী খেলো?
ইয়া বড়ো একটা ডল আছে, ওটা নিয়ে খেলি—৷
ডল তোমার সঙ্গে কথা বলে?
বলে তো৷ ডল আমাকে তুলসী দিদি বলে!
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তো৷ আমি ওকে চকলেট দেই, কেইক দেই—৷
ও খেতে পারে?
খায় তো৷ আমাকে খুব আদর করে,— বলেই সোনালির কোলে ডড়ার জন্য হুটোপুটি শুরু করে দেয়৷
কী হলো, আংকেলের সঙ্গে কথা বলবে না? সোনালি ওকে দু’হাতের মধ্যে নিয়ে বলে৷
বলব তো—৷
তাহলে ওর কাছে যাও৷ কথা বলো—৷
না৷ আমি এখন পড়ব৷ আঙ্কেলও পড়বে৷
কিন্তু স্কুল তো ছুটিয়ে হয়ে গেছে—! সোনালি মজার গলায় বলে৷
হোমওয়ার্ক করব! তুলসীর চটজলদি জবাব৷
তুলসীর চটপটে কথাবর্তা, হাসি, ছুটোছুটি এসব কদিন থেকে আমাকে বেশ মুগ্ধ করে রেখেছে৷ নিজের কর্তব্যকর্ম ভুলে ওর পিছনে ছুটে বেড়াতে ভালো লাগে৷ রোজ সকাল থেকে মিনে মনে তুলসীর অপেক্ষায় থাকি৷ কখন সোনালি ওকে নিয়ে আসবে৷ কখন ওর হাসিভরা অপূর্ব সুন্দর মুখখানা দেখব৷ নীলিমার ফটোর সামনে স্থির হয়ে দাঁড়ানো তুলসীর শান্তমূর্তি দেখব কখন৷ কখন ওর মুখ থেকে শুনব, “আন্টি গুস্সা করে চলে গেছে”—এই কথা৷
তুলসীর কান্নাভেজা চেহারাটা চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল আমার৷ এই ক’দিনে কখনও তুলসীর কান্নাভেজা চেহারা বা গোমড়া মুখ দেখিনি আমি৷ সর্বদা দেখেছি তার হাসিভরা প্রফুল্ল চেহারা৷
এই মুহূর্তে গিয়ে যদি আমি তুলসীর সামনে দাঁড়াই, তবে কী কদিন আগের একদুপুরে পাড়ার নেমন্তন্ন বাড়ির ভিড়ে আমাকে দেখে যেভাবে মুখভরা হাসি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোলে, সেভাবে ফোঁপানো কান্না নিয়ে ছুটে আসবে আমার কাছে, না সোনালির কোলেই মুখ গুঁজে থাকবে তীব্র অভিমানে?
তুলসী যখন ওর মাতৃগর্ভে তখন থেকেই তো বলতে গেলে সোনালির সঙ্গে ওর সম্পর্ক৷ পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলার পর থেকে আজ অব্দি সে তো দিন-রাতের ১২/১৪ ঘণ্টা সময় ধরে সোনালিকে দেখে আসছে, ওর কোলে-কাঁধে চড়ে, ওর নিরন্তর যত্ন-আত্তিতে বড়ো হয়েছে, ওকে মা বলে জেনেছে৷ তুলসীর জন্মদাত্রী মা তো অফিসে যায় তার জন্য টাকা আনতে, যা দিয়ে সে ডল কেনে, কেক কেনে, চকলেট কেনে,—তার প্রকৃত মা সম্পর্কে তো ওরকমই বলে তুলসী—৷
একদিন বেশ ক্লান্ত সুরে সোনালি আমাকে বলে—জানেন মেসো, এভাবে আর ভাল্লাগে না, সারাদিন বন্দীদশা, কাজটা আর করব না ভাবছি—৷
কিন্তু তোমার চলবে কেমন করে,—সোনালিকে প্রতু্যত্তরে বলেছিল৷ ওর নিদারুণ অভাবে কথা তো আমি জানি৷ দুটি ছেলে-মেয়ে আর প্রায় পঙ্গু স্বামীকে নিয়ে গত ক’বছর থেকে বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছে সে৷
আর এ ছাড়াও,—সোনালিকে বলি আমি, তুমি কী পারবে তুলসীকে ছেড়ে থাকতে—?
পারব কী না বলতে পারি না৷ সংশয়ান্বিত কণ্ঠে বলে সোনালি৷
তুলসী ওতো তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না—৷ ওর কথার পিঠে আমি প্রতু্যত্তরে বলেছিলাম৷
হ্যাঁ মেসো, তাও ভাবি৷ তবে কী জানেন, ওর মামা-মামী, দাদু-দিদা বা কাকু-পিসিরা যখন বেড়াতে আসে তখন তুলসী ওদের সঙ্গে এমনভাবে মিলে যায়,—যেন আমাকে চেনেই না, সে সময় সহজে সে আমার কাছে আসতেও চায় না—!
বলছ কী—!আমি অবাক হয়ে বলেছি৷
ঠিক বলছি মেসো৷ তখন তো ওর ওদের সঙ্গে ওঠা-বসা, চান-খাওয়া-শোওয়া, কথা বলা, হাসি, খেলা৷ আমি তো তখন আর তার কেউ নই—! অভিমান-রুদ্ধ কণ্ঠস্বর কেমন গুমরে ওঠে সোনালির৷
জাত্যাভিমান—! শব্দটা আমার মনে বিদ্যুৎচমকের মতো উদয় হয়৷ তুলসীর মধ্যে ভাবটি কি শিশু বয়সেই ফুটে ওঠা সম্ভব—৷
আমার অধীত বিদ্যানুযায়ী ভাবি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অণুপরিমান জীবনকণিকার মধ্যে মানুষের সবকিচু াব্যক্ত আকারে আছে৷ যেমন—মন ও তার কাজ, বাসনা ও প্রবণতা৷ অনুকুল পরিস্থিতিতে তা ব্যক্ত হয়, ফুটে ওঠে৷ তুলসীর জীবনকণিকা ও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়৷ শিশুবয়সে জাত্যভিমান রূপী সংশয় পরোক্ষভাবে থাকলেও বয়সকালে তা প্রত্যক্ষ হবে৷ এ প্রসঙ্গে একজন মহাজনের কয়টি কথা আমার মনে পড়ে৷ তিনি বলেছিলেন : সত্বঃ রজঃ তমঃ এই তিনটি মানুষ মাত্রেই সাধারণ গুণ৷ এই তিনটিই প্রকৃত জাতি৷ এই তিনগুণ পরিত্যাগ না করিলে জাতি পরিত্যাগ করা যায় না৷ এককথায় বলিতে গেলে অভিমানই জাতি৷ এই অভিমান পরিত্যাগ না করিলে জাতি পরিত্যাগ হয় না৷ যাহার তাহার অন্ন ভোজন করিলেই জাতিভেদ যায় না৷ অভিমান পরিত্যাগ কর, সমদর্শী হও, জাতিভেদ আপনা হইতেই চলিয়া যাইবে!
আমি সোনালির ব্যথক্লিষ্ট, ছায়াঘন মুখছবির দিতে তাকিয়ে কথাগুলি ভাবি৷ কিছু বলি না ওকে৷ মুহূর্তে তার প্রতি কোন সান্ত্বনা বাক্যও আমার মনে আসে না৷