যুব দর্পণ
আমার সরস্বতী নাকি তোমাদের সরস্বতী
সোমশিখা মজুমদার
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
বাঙালির সরস্বতী পুজা কি শুধুই মা বীণাপাণির পুজা নাকি
এই পুজার সাথে জড়িয়ে আছে এই জাতির কিশোরকিশোরী দের, যুবক-যুবতিদের অন্যরকম কিছু আবেগ।
এই পুজার দিনক্ষণ কাছে আসলেই অনেকেরই মনে হয় বসন্ত এসে গেছে।
এই আবেগেরই কিছু কথা তুলে ধরেছেন তরুণী সাংবাদিক সোমশিখা ...
ছোটবেলায় মা যখন ভাদ্র মাসে, মায়ের শাড়ি গুলো আলমিরা থেকে বের করে রোদে দিতো তখন থেকেই আমার মনে বসন্তের কোকিলের গান বেজে উঠতো। আপনারা যারা এই লেখাটা পড়ছেন তারা হয়তো ভাবছেন, ভাদ্র মাসে আবার কোকিলের ডাক কোথায় শুনতে পায়! আসলে ভাদ্র মাসের এই কড়া রোদে যখন মায়ের শাড়ি গুলো এক এক করে বাইরে বেরিয়ে আসে, তখন রোদের সোনালী রঙে ঝলমল করতে থাকা শাড়িগুলো থেকেই বহু কষ্টে একটা বেঁছে রেখে দিই প্রতি বছর, আগামী বছরের সরস্বতী পূজার জন্য। তার সাথে ম্যাচিং নানা রকম সাজ-গোঁজের সরঞ্জামও ঠিক হয়ে যায়।
যদিও সরস্বতী পুজা মানেই ছাত্র-ছাত্রীদের পুজা অর্চনা। কিন্তু দুপুর হলেই অনেক ছেলে মেয়েরা নিজের সেরা পাঞ্জাবী বা শাড়ি পরে সাজুগুজু করে বেড়িয়ে পড়ে। সে পড়ুয়াই হোক কিংবা চাকরিয়ান, তাঁর কাছে এই দিনটির বিশেষত্বই আলাদা। আসলে এই দিনের শুরুটা বিশেষ করে হয় ক্লাস নাইনের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব ভার নিজেদের কাঁধে পড়ার পর থেকে। প্রথম স্কুল ইউনিফর্ম ছাড়া নিজের সেরা সাজ দিয়ে স্কুলে আসা। স্কুলের সব থেকে সুন্দরী মেয়েদের প্রথম গোলাপ পাওয়ার স্বাদটাও সেইদিন থেকেই হয়। কারন সরস্বতী মা কে যতই পড়াশোনায় আমরা বেঁধে রাখিনা কেন বিদ্যার দেবী কিন্তু আমাদের ভালোবাসা-বাসির একটা পাসওয়ার্ড দিয়েই দেন। তাই তো আজকাল, সকালে অঞ্জলির সময় যতই ঢাকের আওয়াজ শোনা যাক না কেনো, দুপুর গড়াতেই ঢাকের আওয়াজ থেকে বাইকের ও স্কুটির প্যাঁপু... প্যাঁপু.... আওয়াজ গুলোই বেশি করে কানে বাজে, তারই সাথে ধুপকাটির কিংবা ধূপের গন্ধ পরিবর্তিত হয় নামি দামি ব্র্যান্ডের পারফিউমে।
তা হবে নাই বা কেনো, এমনি কি আর এই দিনটার নাম বেঙ্গলী ভ্যালেনটাইন'স ডে দেওয়া হলো! কোন সরস্বতী কার বাইক-স্কুটির আওয়াজে কিংবা Stunt-এ মুগ্ধ হবেন তার কোনো ঠিক নেই। ভালোবাসায় আবদ্ধ হওয়া কি আর এত সোজা, পুজোর কটা দিন আগে থেকেই পার্লারে গিয়ে নিজেদের আরও বেশী সুন্দর দেখানোর জন্য কত কষ্টটাই না করতে হয়, সে কি আর নিমেষে হ্যাঁ বলার জন্য! এই ভাবেই চলতে থাকে...
যদিও সবাই কি আর বাইকের আওয়াজ পছন্দ করেন! তাঁরা এক সাথে বন্ধুদের সঙ্গে এক স্কুল থেকে আরেক স্কুল, কাকে কতটা সুন্দর লাগছে সেই নিয়ে আলাপচারিতা, পুরোনো বন্ধুদের কে পেয়ে সেল্ফি ওঠা এবং সবার থেকে নিজেদের আলাদা করে সুন্দর লাগার তাগিদেও সেই দিন কলেজ ড্রেস, স্কুল ড্রেস ছেড়ে সেজে গুজে আসেন। যাদের খুব একটা প্রেম ভালোবাসায় interest নেই এবং বাইক- স্কুটি-গাড়ির জন্য ট্রাফিক বাড়ার কারনে মুখে রাগের আকৃতিও অল্প অল্প থাকে, তাঁরাও কিন্তু চালক ছেলেটি মুচকি করে একবার হেসে দিলেই, একটিবারের জন্য হলেও সেই মন ছোঁয়া আলতো হাসির জালে আটকা পড়েন এবং সেটাই হয়ে যায় সেই দিনের ভালোলাগার থিম সং।
যাই হোক আবার নিজের কথায় ফিরে আসি। আমার জল্পনা কল্পনার শুরু সেই ভাদ্র মাস থেকেই। তারপর আস্তে আস্তে পুজোর দিনটা চলে আসলে, সকালেই মায়ের কাছে সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমল-লোচনে.... বলে টলে বিদ্যাবুদ্ধির সব বই পত্র, হারমোনিয়াম দিয়ে আমি একদিনের বিরতিতে চলে যেতাম। আর বাড়ির পুজো শেষ হতেই নিজেকে ভালোবাসার জগতে ভাসিয়ে তুলতে, মা-বৌদির সাহায্যে নিজেকে সাজিয়েগুছিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম বন্ধুদের সঙ্গে (Co-Ed Schoolএ পড়লে বন্ধু-বান্ধবী সব বন্ধু হয়ে যায়)। যদিও আমার প্রথম বন্ধুদের সাথে বের হওয়া মাধ্যমিকের পর। ক্লাস নাইনের সেই প্রথম স্বাদটা আমার কপালে আর জুটলো না। কারন আমার by default, আমার Forever প্রেমিক - বাবার স্কুটারে বসে পুজো দেখার অভ্যাস ছিলো এবং তাই হয়তো কেউ আর আস্পর্ধা করেনি।
কিন্তু যে বছর বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম বের হলাম, সে বছরই হলুদ আর নিম বাটা গাঁয়ে লাগার পর নতুন করে বসন্তের হাওয়া গায়ে লাগলো। নতুন করে যেন সরস্বতী পূজার মানেটা বুঝলাম। সেই বন্ধু-বান্ধব দের সঙ্গে নানা অঙ্গভঙ্গিতে ফোটো ওঠা, নতুন করে অন্য কলেজের পড়ুয়াদের বন্ধু করে নেওয়া, আরও কত কিছু ... সে নানা ধরণের অভিজ্ঞতা প্রথম বারের মতন। যদিও আমি সদা সিঙ্গল, তাও বন্ধুদের প্রেম দেখে আমার নজরটাও নিজের ওপর অন্যরকমভাবে পড়লো। তার পরের বছর থেকে তো নিজেকে আরো এক ধাপ বেশী অন্যরকম দেখানোর জন্য সাজুগুজুর মাত্রাও বেড়েই চলল।
কিন্তু যতই সরস্বতী পুজাকে বেঙ্গলী ভ্যালেন্টাইন'স ডে বলি না কেন, আমার মত পেটুকের চোখটা মেনুর দিকেই বেশী থাকে। কোন স্কুলের প্রসাদ ভালো, কোন স্কুলের খিচুড়ি, আর কোন স্কুলেরই বা ফ্রাইড রাইস ভালো সেই জল্পনাকল্পনায় আমার সরস্বতী পূজা কিংবা ভালোবাসার পুজা, পেট পুজায় এসে ইতি হয়। খাওয়ার দিকে চোখটা এখনও পড়ে রয়েছে বলেই হয়তো এখনও সিঙ্গল রইলাম। তবুও এবছর যারা ভালোবাসার পাত্র পাত্রী জোটাবেন কিংবা এবার প্রথম প্রেমের বাতাস লাগাবেন তাদের জন্য একটি সতর্কতামুলক বার্তা রইল। মুখে মাস্ক অবশ্যই লাগিয়ে বের হবেন, তাতে পাড়াতুতো দিদি-কাকি-জেঠি-মাসি-পিসিরা চিনতেও পারবেন না আর আপনিও সুস্থ সবল থেকে চুটিয়ে প্রেমটা করতে পারবেন ...
